১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়, কিন্তু সেই যুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীনতার প্রথম প্রহরেই যে জাতীয় স্বার্থকে বিদেশি শক্তির কাছে বন্ধক রাখা হয়েছিল, সেই ভয়াবহ সত্যটি আজও অনেকের অজানা। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর চোখ দিয়ে দেখা সেই ইতিহাস আজও প্রশ্ন তোলে—বাংলাদেশ কি প্রকৃতই স্বাধীন হয়েছিল, নাকি এক পরাধীনতামূলক চুক্তির বেড়াজালে বন্দি হয়ে পড়ে আরেক প্রভুর ছত্রছায়ায়?
১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে সাপ্তাহিক হক-কথা পত্রিকায় মাওলানা ভাসানী যে ভয়ানক অভিযোগ তুলেছিলেন, তা আজকের প্রেক্ষাপটে আরও ভয়ানকভাবে সত্য হয়ে উঠছে। তাঁর ভাষ্যমতে, স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের সাথে এমন সাতটি গোপন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, যেগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক এমনকি পররাষ্ট্রনীতিকেও একপ্রকার ভারতের অধীনে নিয়ে যায়। চুক্তিগুলো এতটাই ভয়াবহ ও লজ্জাজনক ছিল যে, তখনকার সরকার জনগণের সামনে তা প্রকাশ করতেই সাহস পায়নি।
ভাসানীর ভাষায়, এই চুক্তিগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশকে ভারতের কাছে ‘একশ বছরের জন্য বন্ধক’ রাখা হয়েছিল। রক্ষীবাহিনী গঠনের পেছনে ভারতীয় ব্লুপ্রিন্ট, সামরিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ ক্রয়ে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ, পণ্য আমদানির নামে বৈদেশিক মুদ্রা শোষণ এবং বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় তৈরি ‘আধা-সামরিক’ বাহিনীর ছায়া ছিল এই চুক্তিগুলোর প্রধান দিক। রক্ষীবাহিনীর মাধ্যমে রাজনীতিতে ভারতের মনোনীত সরকার টিকিয়ে রাখা এবং বিরোধীদের দমন করাই ছিল এক নম্বর লক্ষ্য।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকেও চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভারতের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিচালনার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। এ চুক্তির মাধ্যমে ভারত নিশ্চিত করেছিল, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নীতি কখনও তাদের বিরুদ্ধে যাবে না। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল চেতনাই এক ভয়াবহ ধোঁকায় পরিণত হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে ভাসানী কটাক্ষ করে বলেন, তাজউদ্দীন কলকাতায় গিয়ে ভারতীয় নেতাদের আশ্বস্ত করেন যে, “বাংলাদেশকে ভুল বুঝবেন না। আমরা আপনাদের স্বার্থেই কাজ করছি।” ভারতকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে যেভাবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেটাই ভাসানী বর্ণনা করেছেন এক ভয়াবহ ‘বন্ধকী শৃঙ্খল’ হিসেবে।
বর্তমান সময়ে এই ইতিহাসের পুনর্পাঠ জরুরি হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে যখন শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের পতনের গুঞ্জন চারদিকে। এই পতনের সম্ভাবনায় ভারতের কূটনৈতিক মহলে এখন যে সবচেয়ে আলোচিত নাম, তা হলো তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার। শেখ হাসিনার বিকল্প নেতা খুঁজতে গিয়ে দিল্লির রাজনৈতিক চিন্তাশীলরা আবারও ফিরছেন সেই পুরনো পরিবারের দিকে—যাদের হাতেই একদা ভারতের স্বার্থ রক্ষায় ‘বন্ধক দলিল’ স্বাক্ষর হয়েছিল।
তাজউদ্দীনের কন্যা সিমিন হোসেন রিমি এবং পুত্র সোহেল তাজ—দুই জনেই একসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। সোহেল তাজ হঠাৎ করে পদত্যাগ করলেও তাঁর সামাজিক ভাবমূর্তি, তরুণ সমাজে গ্রহণযোগ্যতা এবং একটি ‘পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক’ ভাবমূর্তি তৈরি করা হয়েছে দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। বর্তমানে তাঁকে আবার রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার জন্য একাধিক মহলের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে—এই পুনর্বাসনের নেপথ্যে কি ভারতের আশীর্বাদই প্রধান চালিকাশক্তি?
যদি সত্যি শেখ হাসিনার বিকল্প হিসেবে তাজউদ্দীন পরিবারকে ব্যবহার করে ভারত আবার বাংলাদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে, তবে এটি হবে ১৯৭২ সালের সেই গোপন চুক্তির পুনরাবৃত্তি। শুধু নেতৃত্ব বদলাবে, কিন্তু পরাধীনতার চক্র থেকে জাতি মুক্ত হবে না।
ভাসানী বলেছিলেন, “বাংলাদেশকে বেকায়দা অবস্থায় পেয়ে এমনি ঠগ ও শঠতাপূর্ণ চুক্তিতে বাঁধা হয়েছিল।” আজকের প্রেক্ষাপটেও যখন বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক বিকল্প খুঁজছে, তখন সেই বিকল্পকে ভারতের আর্শীবাদপুষ্ট কিছু পরিবার বা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার ষড়যন্ত্র চলছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই সময়ের দাবি।
বাংলাদেশের ভবিষ্যত নির্ভর করছে—একটি স্বাধীন ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ নেতৃত্ব গঠনের ওপর, নাকি সেই পুরনো বন্ধকীকৃত রাজনীতির হাতছানিতে ফিরে যাওয়ার ওপর। ইতিহাসের শিক্ষা হলো—যে জাতি নিজের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে স্বাধীনতা হারায়, তারা অর্থনৈতিকভাবে কখনোই মুক্ত হতে পারে না।
আজ প্রয়োজন সেই সাহসী প্রশ্ন তোলা, যে প্রশ্ন একদা ভাসানী তুলেছিলেন। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম যদি আবারও সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বের হয়, তবে হয়তো সত্যিকারের স্বাধীনতার সূর্য একদিন উদিত হবেই।