সম্প্রতি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি)-এর সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন এবং মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার আসিফ মাহতাব উৎসকে প্রকাশ্যে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ‘অ্যান্টার্কটিকা চৌধুরী’ নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এই হুমকি দেওয়া হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য ভুক্তভোগী দুজনের পক্ষ নিয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং পাশাপাশি যারা এই হুমকিদাতার পক্ষে দাঁড়িয়েছে, সেই ‘নামধারী প্রগতিশীলদের’ তীব্র সমালোচনা করেছেন।
ড. সরোয়ার এবং আসিফ মাহতাবকে গত মঙ্গলবার ফেসবুকে একটি পোস্টের মাধ্যমে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। হুমকিদাতা ‘অ্যান্টার্কটিকা চৌধুরী’ নামের ওই অ্যাকাউন্টে ড. সরোয়ারের কার্টুনের পাশে চাপাতির ছবি দিয়ে লিখেছে, “আপনার আইনি অধিকারের বিরুদ্ধে যারা, সেই সব জনব্যক্তিকে হত্যা করুন।” অন্যদিকে, আসিফ মাহতাবের স্কেচের সঙ্গে আরও বিভৎস চিত্র এঁকে লেখা হয়, “আপনার আইনি অধিকারের বিরুদ্ধে যারা, সেই সব জনব্যক্তির কর্তিত মস্তক নিয়ে ফুটবল খেলুন।”
ড. সরোয়ার জনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণার জন্য পরিচিত, বিশেষ করে থ্যালাসেমিয়া ও শিশুদের স্থূলতা বিষয়ে। অপরদিকে, আসিফ মাহতাব বিভিন্ন সমসাময়িক ইস্যুতে তার মতামতের জন্য পরিচিত এবং ফিলিস্তিনের পক্ষে তার অবস্থান আলোচিত। ২০২৩ সালে তিনি সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ক গল্পের সমালোচনা করে বিতর্কের মুখে পড়েন। এই দুই অ্যাক্টিভিস্ট ট্রান্সজেন্ডার ও সমকামিতা ইস্যুর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের এই অবস্থানের কারণেই সমকামিদের পক্ষ থেকে এই হুমকি দেওয়া হয়েছে। ড. সরোয়ার এই হুমকিকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ছাড়াও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য হুমকি বলে মন্তব্য করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, সাইবার ইউনিট হুমকিদাতার পরিচয় শনাক্তে কাজ করছে।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পিনাকী ভট্টাচার্য তার ফেসবুক পোস্টে সরোয়ার ও আসিফের পক্ষে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “আসিফ মাহতাব উৎস আর সারোয়ারকে প্রকাশ্যে খুনের হুমকি দিছে একজন। শুধু তাই না সেই খুন কীভাবে করবে সেটাও বলেছে, সেটার ছবিও একেছে বিভৎসভাবে।” তিনি উল্লেখ করেন যে, এই হুমকিদাতা ব্যক্তিটিকে তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং সে সোশ্যাল মিডিয়ায় কীভাবে অস্ত্র তৈরি করতে হয়, তাও শেখায়।
পিনাকী ভট্টাচার্য সরাসরি পুলিশের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন এই ‘বিকৃতমস্তিষ্ক’ ব্যক্তিকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনের হাতে সোপর্দ করার জন্য এবং তাকে মানসিক পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “আসিফ এবং সারোয়ারের নিরাপত্তার দাবী জানাইতেছি।”
তবে, পিনাকী ভট্টাচার্যের ক্ষোভ কেবল হুমকিদাতার প্রতি সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি বাংলাদেশের একদল ‘নামধারী প্রগতিশীলদের’ একহাত নেন, যারা এই ঘৃণ্য কাজের সমর্থন করছেন। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, “কিন্তু না বাঙ্গু পোগতিশিলেরা আছে না। তারা কইতেছে এইটা অন্যায় হইছে। কারণ সে ট্রান্স এক্টিভিস্ট।” তার মতে, এই প্রগতিশীলরা হুমকিদাতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলছে যে, উল্টো সরোয়ার আর আসিফের ক্ষমা চাওয়া উচিত, কারণ তারাই ঘৃণা ছড়ায়। পিনাকী তার পোস্টে উল্লেখ করেন যে, ১৬২ জন ব্যক্তি, যার মধ্যে জোয়ায়েদ সাকিও রয়েছেন, এই ধরনের কর্মকাণ্ডের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি এই ১৬২ জনের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, “তারা কি প্রকাশ্য হত্যার হুমকি দেয়াকে বৈধতা দিতে চায়?”
এই ঘটনাটি কেবল দুই ব্যক্তিকে হুমকির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বাংলাদেশের সমাজে চলমান বিভাজন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপের একটি স্পষ্ট প্রতিফলন। একদিকে, যারা নির্দিষ্ট সামাজিক ইস্যুতে ভিন্ন মত পোষণ করেন, তারা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাবে ভুগছেন। অন্যদিকে, যারা সহিংসতার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন, তারা কিছু মানুষের পক্ষ থেকে এক ধরনের নীরব সমর্থন পাচ্ছেন। পিনাকী ভট্টাচার্যের পোস্টটি এই বিতর্ককে আরও সামনে এনেছে, যেখানে তথাকথিত ‘প্রগতিশীলদের’ নৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হুমকিদাতার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এবং আসিফ ও সরোয়ারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হলে, ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে এবং সমাজের বিভাজন আরও গভীর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।