শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) একমাত্র কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া দীর্ঘদিন ধরে নানামুখী সমস্যা আর অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে। ক্যাফেটেরিয়ায় শিক্ষকদের বসার আলাদা জায়গা নেই, খাবারের মান খারাপ, দাম তুলনামূলক বেশি। প্রশ্ন রয়েছে খাবারের মান, মূল্য নির্ধারণ এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়েও। ক্যাফেটেরিয়ার আশপাশের তুলনায় খাবারের দাম বেশি অথচ পরিবেশ নোংরা, শৌচাগার ব্যবহারের অনুপযোগী এবং পুরো অবকাঠামো পুরনো ও জরাজীর্ণ। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে এলেও দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের মান, পরিবেশ, অবকাঠামো সবকিছুতেই সমস্যা প্রকট। খাবারের আইটেম খুবই সীমিত। কয়েক ধরনের ভর্তা, রান্না করা মাছ ও মুগরী ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যায় না। একই ধরনের খাবার প্রতিদিন পরিবেশন করায় শিক্ষার্থীরা বিরক্ত। খাবারের মানের তুলনায় দাম অনেক বেশি। ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরের শৌচাগার দীর্ঘদিন ধরে অপরিষ্কার ও সংস্কারবিহীন। বসার জায়গার অবস্থাও শোচনীয়। এখনো পুরনো, ভাঙা চেয়ার-টেবিলই ব্যবহার করা হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্য আলাদা বসার জায়গা না থাকায় তারা সাধারণত সেখানে আসতেই চান না।
ক্যাফেটেরিয়ায় পর্যাপ্ত কর্মচারী না থাকায় শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিতে হয়। যে কয়েকজন কর্মচারী আছেন, তারা সেবাদানে অদক্ষ এবং স্বাস্থ্যবিধি মানেন না বলে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ। রান্না করা খাবার এবং কাঁচা মাছ-মাংস একই ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। আবার কিছু খাবারের উপকরণও পুরোনো, নষ্ট হয়ে যাওয়া আরেকটি ফ্রিজে রাখা হচ্ছে, ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। ক্যাফেটেরিয়ার খাদ্য উপকরণ রাখার জায়গাগুলোও নোংরা, যেখান থেকে পচা-বাসি গন্ধ বের হয়। এসব উপাদান দিয়েই শিক্ষার্থীদের খাবার তৈরি করা হচ্ছে। ফলে তারা স্বাস্থ্যঝুঁকি আর অস্বস্তির মধ্যে পড়ছেন। ক্যাফেটেরিয়ার বাইরের পরিবেশও অত্যন্ত নোংরা এবং অপরিচ্ছন্ন।
শিক্ষার্থীরা জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ক্যাফেটেরিয়ার এ অব্যবস্থাপনা দেখে আসছেন তারা। মাঝে মাঝে ভেতরটা কিছুটা পরিষ্কার থাকলেও বাইরের অবস্থা অধিকাংশ সময়ই নোংরা। কর্মচারী কম, যারা আছে তারাও দায়িত্বশীল নয়। দুপুরে খাবার খেয়ে যথাসময়ে ক্লাসে পৌঁছানো কঠিন হয়ে যায়। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়েই ক্যাফেটেরিয়ায় খেতে হয়। খাবারের দামের সঙ্গে মানের কোনো সামঞ্জস্য নেই। বারবার বলা হলেও কোনো সংস্কার হয়নি।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে এএসভিএম অনুষদের সাব্বির হোসাইন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরে-বাইরে অপরিচ্ছন্নতা ও অব্যবস্থাপনা দেখে আসছি। ক্যাফেটেরিয়ায় কর্মচারী কম, খাবারের মান-দামেও সমস্যা। দ্রুত ক্যাফেটেরিয়া সংস্কার করা প্রয়োজন। মাস্টার্সে অধ্যয়নরত মেহেদী আমিন জানান, খাবারের মান খুবই খারাপ। কোন ভর্তা খাচ্ছি তা বোঝা যায় না। ক্যাফেটেরিয়ার স্টাফরা সেবার উপযোগী নয়। দীর্ঘদিন ধরে আমরা এই অবস্থার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কোনো সংস্কার হয়নি। খাবারের আইটেম বাড়ানো দরকার এবং একই ধরনের মেনু প্রতিদিন পরিবেশন না করে বৈচিত্র্য আনা উচিত। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় নজর দেওয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষকদের মর্যাদা বিবেচনায় দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।
এই বিষয়ে শেকৃবির সিওয়াইবি সংগঠনের সভাপতি ও ফুড সেফটি বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত কাজী নাফিস সোয়াদ বলেন, শিক্ষার্থীদের অনেক অভিযোগ সত্য। ক্যাফেটেরিয়ার বাইরে অপরিষ্কার, অবকাঠামো সুসজ্জিত নয়, চেয়ার-টেবিল পুরোনো-ভাঙা। ক্যাফেটেরিয়া কর্তৃপক্ষকে আমরা আমাদের পক্ষ থেকে খাবারের মান নিয়ে সচেতন হতে বলেছি। তবে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং অব্যবস্থাপনার সমাধানে ক্যাফেটেরিয়া কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি অনুষদের এক সিনিয়র শিক্ষক বলেন, অব্যবস্থাপনার কারণে আমরা ক্যাফেটেরিয়ায় যাই না। শিক্ষকদের বসার কোনো আলাদা জায়গা নেই। চেয়ার-টেবিল ভাঙা। বাইরের পরিবেশ নোংরা। ক্যাফেটেরিয়া যেভাবে ছিল, এখনও সেভাবেই চলছে।
অভিযোগের বিষয়ে ক্যাফেটেরিয়ার পরিচালক মোহাম্মদ জামান বলেন, ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করি। তবে বাইরের জায়গা শেকৃবি প্রশাসনের। আমরা জায়গাটা চাইলেও তারা দেয়নি। বাইরের জায়গা প্রশাসন পরিষ্কার করে না। খাবারের আইটেমের বিষয়ে বলেন, যেটুকু আছে, সেটুকুতেই শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো খেতে আসে না। বেশি আইটেম দিলে অপচয় হবে, আমার লোকসান হবে। রান্না করা খাবার আর কাঁচা মাছ-মুরগি একই ফ্রিজে রাখি না। অল্প বাজার করি, অল্প করেই খাবার পরিবেশন করি। এখন ক্যাফেটেরিয়ায় ১২ জন স্টাফ কাজ করছে। তারা শিক্ষার্থীদের সেবা দিতে চেষ্টা করছে। রান্নার উপকরণ বাইরে রাখলে নষ্ট হবে, তাই আলাদা ফ্রিজে রাখা হয়। ক্যাফেটেরিয়ার চেয়ার-টেবিল আমার নিজস্ব। প্রশাসন কোনো সহযোগিতা দেয় না। অথচ প্রতি মাসে প্রশাসনকে ৩০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এখানে মাঝে মাঝে শিক্ষকরা আসেন, সবই তাদের নজরে। কিন্তু সংস্কারের বিষয়ে কিছু বলেন না। প্রশাসন সহযোগিতা করলে ক্যাফেটেরিয়া সুসজ্জিত করা সম্ভব। শিক্ষকদের বসার জায়গা আগেও ছিল, কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলো নিয়ে নিয়েছে। তাই বিকল্প জায়গা আর পাইনি। খাবারের দাম প্রসঙ্গে বলেন, বাজারে সবকিছুর দাম বেড়েছে। সে অনুযায়ী দাম ঠিক করেছি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা ভেবেই মূল্য নির্ধারণ করি।
এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল লতিফ বলেন, ক্যাফেটেরিয়ার বাইরের জায়গা আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি পরিষ্কার রাখতে। তবে অনেক সময় শিক্ষার্থীরা ময়লা ফেলে রাখে। ক্যাফেটেরিয়া উন্নয়নের বিষয়ে বলেন, আমরা ক্যাফেটেরিয়া উন্নত করার পাশাপাশি টিএসসিতে নতুন ক্যাফেটেরিয়া করার পরিকল্পনা নিয়েছি। টাকার বিষয় রয়েছে, তবে ধীরে ধীরে আমরা কাজ শুরু করব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েরই দাবি, ক্যাফেটেরিয়ার অব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, খাবারের মান ও কর্মচারী সংকট দ্রুত সমাধান করা হোক। একইসঙ্গে শিক্ষকদের জন্য বসার আলাদা জায়গা, ন্যায্য দাম, উন্নত স্বাস্থ্যবিধি এবং নিয়মিত পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা হোক। তারা বলছেন, স্বাস্থ্য, স্বস্তি আর সম্মানের বিষয়টি মাথায় রেখে শেকৃবি প্রশাসনকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।