মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা রাখাইন রাজ্যে আবারও রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখে। সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইন রাজ্যের বেশিরভাগ এলাকা দখল করে নেওয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘আরাকান আর্মি’র বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা জনগণের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’। সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, আরাকান আর্মির সদস্যরা রাখাইন অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মারধর, অপহরণ, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, লুটপাট এবং জোর করে গ্রাম থেকে উৎখাতের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে।
গত দুই বছরের মধ্যে রাখাইনসহ মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় দেশটির সামরিক জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ নামক বিদ্রোহী জোট অস্ত্রধারী হামলা চালিয়ে আসছে। এই জোটের সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠী হচ্ছে আরাকান আর্মি, যারা রাখাইনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বেশিরভাগই এখন আরাকান আর্মির দখলে। তবে স্থানীয় রোহিঙ্গারা প্রথমে সামরিক বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় আজ তারা আরাকান আর্মির রোষানলে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
মাঠ পর্যায় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অনেক রোহিঙ্গা তরুণকে আরাকান আর্মি জোর করে অপহরণ করে তাদের বাহিনীতে যুক্ত করছে। কারও কারও পায়ে গুলি করা হয়েছে, কাউকে রাতের আঁধারে ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একাধিক রোহিঙ্গা নারী জানিয়েছেন, তাদের স্বামী ও ভাইদের আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ বেঁচে ফিরে এসে বলেছেন, চোখ বেঁধে রাখা অবস্থায় তাদের দিনের পর দিন বাঁশ দিয়ে পেটানো হয়েছে। অনেককে ‘জান্তার দালাল’ বলে দোষারোপ করে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
Fortify Rights নামের একটি মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানায়, রাখাইনের বু থি দং এবং মারউক ইউ অঞ্চলের অন্তত পাঁচটি রোহিঙ্গা গ্রামে এই নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “আমি নিজের চোখে দেখি—বারো জন রোহিঙ্গার রক্তাক্ত দেহ মাটিতে পড়ে আছে। কয়েকজনের মাথা থেঁতলানো, কেউ কেউ মার খেতে খেতে নিথর হয়ে গেছে।” এসব ঘটনা আরাকান আর্মির কড়া সামরিক শাসনের ইঙ্গিত দেয়। তারা স্থানীয় জনগণকে বাধ্য করছে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় চলাফেরা করার জন্য অর্থ দেওয়ার। একেকবার যাতায়াতের জন্য দিতে হয় ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ কিয়াট।
রিপোর্টে আরও জানানো হয়, যারা অর্থ দিতে অস্বীকার করে, তাদের উপর নেমে আসে ভয়াবহ নির্যাতন। বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। গবাদিপশু পর্যন্ত লুট করে নিয়ে যাচ্ছে বিদ্রোহীরা। এমনকি কবরস্থান পর্যন্ত ধ্বংস করে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
২০২৩ সালের শেষদিকে মিয়ানমারের সেনা জান্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হলে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ, বিশেষ করে ‘আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি’ (এআরএ), ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) এবং ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন’ (আরএসও) জুন্টা বাহিনীর সঙ্গে একত্র হয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। তবে যুদ্ধের গতিপথ বদলে যাওয়ায় রাখাইনের অধিকাংশ এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে এবং তারা প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে রোহিঙ্গাদের ওপর। আর এ কারণে গত কয়েক মাসে আরও দেড় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
বাংলাদেশ সীমান্তেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্পে কাজ করা রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, নতুন করে অনেকে পালিয়ে আসছে। সীমান্তে গুলি ও মর্টার শেলের শব্দ প্রায় নিয়মিতই শোনা যায়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সীমান্তে বাড়তি নজরদারি শুরু করেছে। তবে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা সীমান্তে আটকা পড়ে আছে যারা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে পারছে না।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছে, এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করে এর জন্য দায়ীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার করতে হবে। সংস্থাটি আরও বলেছে, “২০১৭ সালের গণহত্যার পর রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আশ্রয়ের স্বপ্ন আজ ফের দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে।” Amnesty International-ও এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, রোহিঙ্গারা বর্তমানে তাদের অস্তিত্বের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে এবং তাৎক্ষণিক আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি অসম্ভব।
অন্যদিকে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো মনে করছে, এই সংকট শুধু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। এর প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশের ওপর পড়ছে। অতএব জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত এই বিষয়টিকে মানবিক সংকট হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।
রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের এই ধারাবাহিক চিত্র নিঃসন্দেহে মানব সভ্যতার জন্য এক গভীর উদ্বেগের বার্তা। একদিকে স্বাধীনতার নামে বিদ্রোহ, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার অভাবে নিরীহ জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে—এই দোটানার মাঝখানে রোহিঙ্গারা এখন এক অবরুদ্ধ জীবনের প্রহর গুনছে।