১) মূলত ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের পতনের মধ্য দিয়েই দক্ষিন-পুর্ব এশিয়ার এ অঞ্চলে আধুনিক গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু। এ যাত্রার মধ্য দিয়েই মানব ইতিহাসের অন্যতম রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ ‘গণতন্ত্র’ এ অঞ্চলে প্রথমবারের মত প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতন্ত্রে মানুষের অধিকারকে সম্মান দিয়ে এর বাস্তবায়নই রাষ্ট্রের একমাত্র দায়িত্ব বলে স্বীকৃত হয়। এ কাঠামোয় জনসেবার ধারণা জনচুক্তির আওতায় আসে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে। কিভাবে এ ইতিহাস সৃষ্টিকারী ধারণা সংবিধানে স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং সংবিধানে তা কিভাবে বিধৃত হয়েছে তা জানা থাকলে এদেশের জনগণ এবং জনসেবা বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত ‘কর্মচারীপর্ষদ’ উভয়ের জন্য সুবিধা হবে। এতে জনগণ তার অধিকার আদায়ের জন্য যেমন দাবি জানাতে পারবে, তেমনি, রাজনৈতিক দল বা সরকারি কর্মচারীবৃন্দ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি এবং তা বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারবে। উন্নত দেশগুলোতে সকল নাগরিকের জন্য জনসেবার নিশ্চিয়তা থাকলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এখনো জনসেবা নাগরিকদের নিকট আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি। এর মূল কারণ, জনসেবার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের গণতন্ত্রের ইতিহাস, জনসেবার ধারণা, তার উৎপত্তি, তার মাত্রা ও ব্যপ্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণার অভাব। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের সংবিধানে কিভাবে জনসেবার ধারণা স্থান পেয়েছে তা এ প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে।
২) দক্ষিণ এশিয়ার ৩টি দেশের মধ্যে সর্ব প্রথম ভারতের গণতান্ত্রিক সংবিধান পাস হয়। এ সংবিধান ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর মাসে তৎকালিন গণপরিষদে পাশ হয় এবং ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে এটি কার্যকর হয়। এ সংবিধানে সে সময় ৩৯৫টি অনুচ্ছেদ থাকলেও বর্তমানে প্রায় ৪৫৬ এর বেশি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এই সংবিধানের প্রি-এ্যাম্বল (প্রস্তাবনা) ও ভাগ-০৪ তে নাগরিক-কেন্দ্রিক সেবার মৌলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে এবং সংবিধানের ৩০৯ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপ্রধান কে জনসেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তে ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক পাবলিক সার্ভ্যান্ট নিয়োগের আইনী ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। অন্যদিকে সংবিধানের প্রস্তাবনায় সকল নাগরিকের ব্যক্তিক মর্যাদা, সুবিচার, স্বাধীনতা ও সমতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। ভাগ-১৪ এর অনুচ্ছেদ ৩১৫ -৩২৩এ ইউনিয়ন সিভিল সার্ভিসে নিয়োগের বিষয়ে এবং ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠনের কথা বলা আছে। ব্রিটিশ পরবর্তী ভারতের সংবিধানে জনসেবা নিশ্চিত করার মত মৌলনীতি প্রনয়নে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহেরু ও বি আর আম্বেদকার গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা ব্রিটিশ যুগের ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের বাহ্যিক কাঠামো ঠিক রাখলেও এমন মৌলনীতি সংবিধানে যুক্ত করেন যাতে সিভিস সার্ভিস অফিসাররা নতুন গণতান্ত্রিক ভারতে গণতন্ত্রের চেতনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে জনসেবা প্রদান করতে পারেন।
৩) ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের সংসদে অনুমোদিত হলেও পরে তা বাতিল হয়েছিল। বর্তমান ২৫০ অনুচ্ছেদের এ সংবিধানটি ১৯৭৩ সালের ১৪ অগাস্ট সংসদে অনুমোদিত হয়। এই সংবিধানের ভূমিকা ও ভাগ ০২-এ সংবিধানের মৌলনীতি বিধৃত হয়েছে। ভারতের সংবিধানের বিপরীতে পাকিস্তানের সংবিধানে জনগণের সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব কে গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে জনগণের সার্বভৌমত্ব সীমিত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং জনগণের কল্যাণের জন্য সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। জনসেবা নিশ্চিত করার জন্য ফেডারেল পাবলিক সার্ভিস গঠন, তাদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও চাকুরীর অন্যান্য বিষয়াবলী ভাগ ১২ এর ২৪০-২৪৫ অনুচ্ছেদে বর্ণনা করা আছে।
৪) বাংলাদেশের ১৫৩ অনুচ্ছদবিশিষ্ট সংবিধান ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর অনুমোদিত হয়। এ সংবিধানের ১৩৩-১৪৪ অনুচ্ছেদে জনসেবা সম্পর্কে বলা আছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় জনগণের সার্বভৌমত্ব, ২য় ভাগে সংবিধানের মৌলনীতি এবং ৩য় ভাগে জনগণের মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে যা জনসেবার জন্য একটি নাগরিক-বান্ধব সিভিল সার্ভিস গঠনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে সকল সময়ে জনগণের সেবা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা একজন সরকারী কর্মচারীর দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে যা এ সংবিধানকে জন-বান্ধব হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের সংবিধানে ২১(২) এর মত কোন অনুচ্ছেদ সুষ্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা নেই। বাংলাদেশের সংবিধানের ৯ম ভাগে সরকারি কর্মচারী নিয়োগের শর্ত ও পদ্ধতি এবং বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের কথা বলা হয়েছে।
৫) বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান এই তিন দেশের সংবিধানেই জনসেবা বা পাবলিক সার্ভিসের মৌলনীতি হিসাবে জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে উল্লেখ রয়েছে। অন্যদিকে সিভিল সার্ভিস যাতে দক্ষতা, সততা, সাহস ও নিরপেক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে সেজন্য মেধাভিত্তিক নিয়োগ এবং চাকুরীতে থেকে বরখাস্ত কিংবা বাতিলের বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংবিধানে জনগণের সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে মহান স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের কথা বলা হলেও জনগণের অভিপ্রায়ে এই সংবিধান প্রণয়ণ করা হচ্ছে এবং জনগণের শান্তি ও সুবিচারই প্রধান লক্ষ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
৬) ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশ শাসিত ছিল বিধায় এদেশের সিভিল সার্ভিসকে নাগরিক বান্ধব করে গড়ে তোলার কাজটি একটু দেরিতে শুরু হয়েছে। মূলত, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশের মাধ্যমেই সিভিল সার্ভিসের অভিমুখ পরিবর্তন হয়েছে। প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত পুরো সময়ে সিভিল সার্ভিসের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সুলতান/রাজা-রাণীদের প্রতিনিধি বা সহকারী হিসাবে আইন-শৃংখলা রক্ষা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচারিক কার্যক্রম এবং রাজস্ব আদায় করে রাজদরবারে প্রেরণ করা। এ হিসাবে সিভিল সার্ভিস ছিল শোষণমূলক ও নাগরিক বিমুখ। রাজা-লর্ডদের সুবিধা চিন্তা করা, নাগরিক ও রাজাদের মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে কাজ করাই ছিল মুখ্য। ক্রমাগতভাবে সভ্যতার বিবর্তনে ও ইউরোপীয় রেনেসাঁর মধ্যে গণতান্ত্রিক ধারার বিকাশের সাথে সিভিল সার্ভিসের লক্ষ্য পরিবর্তিত হয়ে নাগরিক-শোষণ থেকে নাগরিক-বান্ধব হয়ে উঠে। বর্তমান যুগে নিউ পাবলিক ম্যানেজমেন্ট এর আওতায় নাগরিকদের জীবনমানের উন্নয়ন ও নাগরিক সেবার পাশাপাশি নাগরিকদেরকে দেশের পলিসি প্রণয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হচ্ছে। এ হিসাবে ভারতে নাগরিক-কেন্দ্রিক সিভিল সার্ভিসের যাত্রা শুরু হয়েছে ১৯৫০ সালে। পাকিস্তান রাষ্ট্র ১৯৪৭ সালের ১৪ অগাস্ট স্বাধীন হলেও, জনগণ-বান্ধব প্রশাসন এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে ১৯৭৩ সালে জনসেবা-বান্ধব এবং বাংলাদেশে এর যাত্রা শুরু হয়েছে স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে। তবে, সংবিধানে লিখিতভাবে এই যাত্রা শুরু হলেও বাংলাদেশে জনগণ কে কেন্দ্রে রেখে পলিসি প্রণয়ণ ও জনসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনেক অর্জন এখনো বাকি। এজন্য, আইন বা বিধি প্রণয়ণের চেয়েও যে কাজটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, কলোনী-যুগের মাইন্ডসেট থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে জনসেবামুখি প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার একটি সংস্কৃতি চালু করা। বিশাল আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত এই স্বাধীন দেশে গত ৫৪ বছরে জনগণ-কেন্দ্রিক জনসেবার অর্জন কতটুকু তা পেছন ফিরে দেখা এবং একটি বৈশ্বিক মাপকাঠিতে তুলনা করা জরুরিও বটে।
লেখক: উপপরিচালক, রাজউক, ঢাকা । ইমেইল: mahbub.cn@gmail.com