বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারে নিয়োগ ও মানবপাচার অভিযোগে দায়ের করা সিন্ডিকেট মামলা নিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা মানবপাচারের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফলে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ওরফে ‘লোটাস কামাল’-এর পরিবারের সদস্য, সাবেক দুই আওয়ামী লীগ ও এক জাতীয় পার্টির সাংসদসহ প্রায় ১০৩ জন অভিযুক্ত আসামি অব্যাহতি পেতে যাচ্ছেন।
তবে মামলার বাদী প্রতিবেদনের ওপর অনাস্থা জানিয়ে আদালতে ‘নো কনফিডেন্স’ পিটিশন দিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, সিন্ডিকেট গঠনের অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও আসামিরা পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়া প্রভাবিত করেছেন এবং তাদের পক্ষে প্রতিবেদনে মনগড়া তথ্য দেওয়া হয়েছে।
মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যম ‘মালয়েশিয়াকিনি’ সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, মালয়েশিয়ার অনুরোধে বাংলাদেশ সরকার এই মামলার তদন্ত স্থগিত করেছে। গত ১৫ মে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকাকে চিঠি দিয়েছে যাতে ‘অপ্রমাণিত অভিযোগ’ বাদ দিয়ে তাদের অবস্থান আন্তর্জাতিক মানবপাচার প্রতিবেদনে উন্নত করা হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া বলেছেন, “আমি বিষয়টি জানি না, তবে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বিষয়টি দেখছেন।”
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারি সফরের আগে এই মামলা ও তদন্ত নিয়ে ব্যাপক জল্পনা রয়েছে। ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এই মামলায় মালয়েশিয়ার কোনো চাপ রয়েছে কিনা, তিনি জানেন না এবং এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছেন।
তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির মানবপাচার ইউনিটের পরিদর্শক মো. রাসেল টিবিএসকে বলেছেন, “তদন্তে কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় আমরা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছি।”
মামলায় আসামিদের মধ্যে রয়েছেন— সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ, সাবেক সিনিয়র সচিব আহমেদ মুনিরুস সালেহীন, সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, বেনজির আহমেদ, এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালের স্ত্রী কাশ্মিরী কামাল ও মেয়ে নাফিসা কামাল। এছাড়া অন্তত ১০০ রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক ও কর্মকর্তা এই মামলায় অভিযুক্ত।
গত ৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ সালে আলতাব খান নামের এক ব্যক্তি পল্টন থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় উল্লেখ করা হয়, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ২৪ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, শ্রমিকদের কাছ থেকে সরকারি নির্ধারিত ফি’র তুলনায় পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেশি অর্থ আদায় করা হয়েছে। তবে সিআইডি প্রতিবেদনে এসব অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
বাদী আদালতে জানিয়েছেন, সিন্ডিকেটের সদস্যরা পুলিশকে প্রভাবিত করে তদন্তে বাধা দিয়েছে এবং বাদীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। বাদী ৪ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত শুনানিতে ‘নো কনফিডেন্স’ আবেদন জমা দেবেন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের সাবেক জয়েন্ট সেক্রেটারি মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, “সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের অব্যাহতি দেয়া হলে নতুন সিন্ডিকেট গড়ে উঠবে। এটি দেশ ও প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য বড় সংকেত।”
মানবপাচার ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত ১১ মার্চ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে অতিরিক্ত ফি আদায় ও অর্থপাচারের অভিযোগে ১২টি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। মামলায় অন্তর্ভুক্ত একজন হলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। দুদকের অভিযোগ, সরকারি নির্ধারিত ফি’র পরিবর্তে প্রতি শ্রমিক থেকে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ থেকে ৬ লাখ টাকা আদায় হয়েছে। দুদকের মামলাটি এখনও বিচারাধীন।
মালয়েশিয়া সরকার গত বছর মে মাসে অভিযোগ ও অনিয়মের কারণে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করে। মালয়েশিয়ার অনুমোদিত ২,৫০০ এর মধ্যে মাত্র ১০০টি বাংলাদেশি এজেন্সিকে নিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় সিন্ডিকেটের একচেটিয়া প্রভাবের অভিযোগ রয়েছে।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার পুনরায় খুলতে গত ১১ থেকে ১৩ আগস্ট তিনদিনের সফরে যান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সফরে শ্রমবাজারের উন্নয়ন, সিন্ডিকেট নির্মূল এবং দুই দেশের সম্পর্ক জোরদারের বিষয়গুলো আলোচনা হয়।