ইরানের বুকে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর মুখ থেকে শোনা গিয়েছিল এক জ্বালাময়ী বাক্য—“আমরা অস্ত্র তৈরির কেন্দ্রেই আঘাত হেনেছি।” বহুদিন ধরে ইসরায়েল দাবি করে আসছে, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। অথচ এক অদ্ভুত দ্বিচারিতা দেখা যায় ইসরায়েলের নিজের অবস্থানে। প্রশ্ন উঠেছে: ইসরায়েল কি নিজেই পারমাণবিক শক্তিধর নয়?
অথচ তেল আবিব কখনো এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেয়নি। স্বীকারও করে না, আবার অস্বীকারও না। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একে বলা হয় “নিষ্ক্রিয় অস্পষ্টতা” (strategic ambiguity)—যেখানে কথায় না বললেও বাস্তবে অস্ত্রের অস্তিত্ব সবাই জানে। কিন্তু এই জানা কি অলৌকিক অনুমান? মোটেই না। বরং একটি মাত্র ব্যক্তির কণ্ঠে উঠে এসেছিল ইসরায়েলের সেই গোপন পরমাণু জগতের নির্জন সত্য।
১৯৮৬ সালের অক্টোবরে, লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা The Sunday Times প্রকাশ করে এক বোমা ফাটানো প্রতিবেদন—”Revealed: The Secrets of Israel’s Nuclear Arsenal”। উৎস ছিলেন ইসরায়েলি পারমাণবিক প্রকৌশলী মোরেখাই ভানূনু, যিনি কাজ করতেন নেগেভ মরুভূমির গভীরে অবস্থিত ডিমোনা পারমাণবিক কেন্দ্রে।
ভানূনু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি, বরং তিনি হয়েছিলেন একজন হুইসেলব্লোয়ার—যিনি বিশ্বকে জানাতে চেয়েছিলেন এক রাষ্ট্রের গোপন পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডারের কথা। তার গোপনে তোলা ছবিগুলো এবং ভেতরের তথ্য বিশ্লেষণ করে Sunday Times জানায়: ইসরায়েলের কাছে অন্তত ২০০টি পারমাণবিক বোমা রয়েছে, যা তাদেরকে বিশ্বের ষষ্ঠ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
এত বড় ফাঁসের পরে কী পরিণতি ঘটেছিল ভানুনুর কপালে? সিনেমার মতো করেই তাকে রোম থেকে অপহরণ করে নিয়ে আসে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। এই অপহরণ ছিল প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধরার এক ক্লাসিক “হানি ট্র্যাপ”।
ভানূনু’কে ধরা হয় গুপ্তচর ও বিশ্বাসঘাতকের তকমায়। বিচার হয় গোপন আদালতে। সাজা: ১৮ বছরের কারাবাস, যার অর্ধেক কাটে একক নির্জন সেলে। এরপরও তাকে পুরোপুরি মুক্তি দেওয়া হয়নি। আজও তিনি ইসরায়েল ত্যাগ করতে পারেন না।
ইসরায়েল প্রথম দিন থেকেই তাদের পরমাণু কার্যক্রমকে গোপন রাখার কৌশল নিয়েছিল। ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে ফ্রান্সের সাথে এক গোপন চুক্তিতে তারা ডিমোনা কেন্দ্রে পারমাণবিক গবেষণা শুরু করে। বিশ্ববাসীকে বলা হয়েছিল, সেখানে “কাপড় তৈরির কারখানা” চলছে। এমনকি মার্কিন পর্যবেক্ষকরাও বোঝেননি মাটির নিচে লুকিয়ে আছে একাধিক তল বিশিষ্ট গবেষণা ও অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র।
ভানূনুর তথ্য না থাকলে হয়তো এখনও তা কেউ জানত না।
বাকি পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর মতো ইসরায়েল NPT (Non-Proliferation Treaty) বা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে সই করেনি। ফলে আন্তর্জাতিক নজরদারির বাইরেই রয়ে গেছে তাদের অস্ত্রভাণ্ডার। Center for Arms Control and Non-Proliferation অনুসারে, বর্তমানে ইসরায়েলের হাতে প্রায় ৯০টি পরমাণু বোমা থাকতে পারে।
তবে তাদের অবস্থান এখনো স্পষ্ট নয়—তারা কেবল বলে, “মধ্যপ্রাচ্যে আমরা কখনোই প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারকারী হব না।” কিন্তু তাদের এই নীরবতাই আসলে এক প্রকার অস্পষ্ট হুমকি।
ভানূনু আজও এক বিতর্কিত চরিত্র। কেউ বলেন বিশ্বাসঘাতক, কেউ বলেন শান্তির নায়ক। কিন্তু যাই বলি না কেন, তার তথ্য ফাঁস না হলে আজো বিশ্ব জানত না ইসরায়েলের পারমাণবিক মুখোশের ভিতরকার চেহারা কেমন।
প্রশ্নটা তাই ঘুরেফিরে আবার আসে—ইসরায়েল কি পারমাণবিক শক্তিধর?
উত্তর হয়ত রাজনৈতিকভাবে অস্বস্তিকর, কিন্তু বাস্তবভিত্তিতে তা আর কোনো গোপন বিষয় নয়।