স্পেনের গ্রানাডা শহরের হোসে হার্টাডো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন সকালে একদল অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে দিয়ে এসে দাঁড়িয়ে যান দুইটি ব্যানার হাতে। সেখানে লেখা — “আর কোনো মৃত শিশু নয়” এবং “গণহত্যার বিরুদ্ধে”। কখনো দু’জন, কখনো তিনজন, আবার কখনো ১৫ জন পর্যন্ত হলেও সংখ্যার চেয়ে তাদের মানবতা আর প্রতিবাদের আবেদন বড় হয়ে ওঠে।
এই ছোট্ট প্রতিবাদের সূচনা এক অভিভাবক মার ডোমেচ-এর হাত ধরে। তিনি জানান, একটি ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ঘুরছিল। সেটি ২০৪০ সালের এক কাল্পনিক গল্প, যেখানে গাজা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং তখনকার শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের কাছে জানতে চায় — “গণহত্যার সময় তোমরা কী করেছিলে?” এই ভিডিওর অনুপ্রেরণায় ডোমেচ প্রস্তাব করেন, ভিডিও ফরোয়ার্ড না করে কিছু করা উচিত। তখন ঠিক হয়, শিশুরা স্কুলে ঢোকার আগে এবং বের হওয়ার পরের ১৫ মিনিট এ প্রতিবাদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।
প্রতিদিন কোনো শ্লোগান বা স্লোগানমুখর জমায়েত নয়, নীরবতার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানান দেন তারা। স্কুলের পাশের ব্যস্ত সড়কের কারণে এ প্রতিবাদ বেশ দৃশ্যমান। অনেক পথচারী ও গাড়িচালক, এমনকি আলহাম্ব্রা প্রাসাদে বেড়াতে আসা পর্যটকেরাও গাড়ির হর্ন বা হাত নেড়ে সমর্থন জানান।
ডোমেচ বলেন, “আমরা কাউকে অশান্ত করতে চাই না। তবে যেভাবে শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে, সেটা মেনে নেয়া যায় না। আইন-আদালতের পথকেও সম্মান দেখাতে হবে। এই হত্যাযজ্ঞ একধরনের গণহত্যা। আর ভুক্তভোগী যে-ই হোক না কেন, এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত।”
গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রায় দুই বছর পর এখন সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শিশু নির্যাতিত । ইতোমধ্যে ১৭ হাজারের বেশি শিশু নিহত এবং ৯ লাখ ৩০ হাজারের বেশি শিশু অনাহারে পড়ার ঝুঁকিতে। এই তথ্য সেভ দ্য চিলড্রেন-এর।
প্রতিদিনের এই প্রতিবাদে অনেকেই আসতে পারেন না। তবু যারা আসেন, তাদের মধ্যে একধরনের হাস্যরস, অভিমান আর দৃঢ়তা কাজ করে। একদিন পুলিশ পরিচয়ে দুজন কর্মকর্তা এসে পরিচয়পত্র দেখতে চেয়েছিলেন। তখন কেবল দু’জন অভিভাবক ছিলেন। ডোমেচ হাসতে হাসতে বলেন, “পুলিশ আসার কারণে সেদিন মনে হচ্ছিল প্রতিবাদকারীর সংখ্যা হঠাৎ দ্বিগুণ হয়ে গেছে।”
একজন নারী প্রতিদিন এসে ছবি তুলে তা ফিলিস্তিনের এক বন্ধুকে পাঠান। অনেকে গাড়ি থেকে বা বাসের জানালা দিয়ে হাত নেড়ে সমর্থন জানান। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই অভিভাবকদের সাহস জোগায়।
অপর এক অভিভাবক আলবের্তো জানান, “কেবল দূর থেকে দেখেই থাকতে পারছিলাম না। দিন দিন যা ঘটছে, তা খুবই ভয়াবহ। আমি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তাই সময় ম্যানেজ করা সহজ। তবে যারা চাকরি করেন বা সংসার চালান, তাদের জন্য কঠিন। তারপরও এটা করা জরুরি।”
স্পেন এমনিতেই ফিলিস্তিন ইস্যুতে স্পষ্ট অবস্থান নেয়া দেশগুলোর অন্যতম। গত বছর তারা দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা গণহত্যা মামলা-এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে এবং ২০২৪ সালের মে মাসে আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ের সঙ্গে মিলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
সাম্প্রতিক ইউরোপীয় ইউনিয়নের গাজা রিপোর্ট প্রকাশের পর স্পেনই একমাত্র দেশ যারা ইসরায়েলের সঙ্গে ইইউ-ইসরায়েল অ্যাসোসিয়েশন এগ্রিমেন্ট বাতিলের সরাসরি দাবি জানিয়েছে এবং অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দাবি করেছে।
গ্রানাডা স্কুলগেটের এই প্রতিবাদ চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছেন ডোমেচ। বললেন, “স্কুলের ছুটি শেষে সেপ্টেম্বর থেকে আবার শুরু করব। যদিও আশা করি, তখন আর এই প্রতিবাদের প্রয়োজন হবে না।”