পুরো সমাজের ব্যর্থতা আর স্বামীর দায়িত্বহীনতা - দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ
নোটিশ:
শিরোনামঃ
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা, ফেব্রুয়ারিতে ভোট ঢাবির আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের তিন বছরের ডিনস অ্যাওয়ার্ড প্রদান ঢাবি নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের নবীন ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের বরণ ও বিদায় অনুষ্ঠান শেকৃবি কৃষিবিদদের ৩ দফা দাবি নিয়ে আগারগাঁও ব্লকেড মাথার পেছনে গুলির চিহ্ন, রক্তে ভেসে থাকা বুক: ট্রাইব্যুনালে বাবার সাক্ষ্য তিন দফা দাবিতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটডাউন, পরীক্ষা স্থগিত গ্রিনল্যান্ডকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র-ডেনমার্কে নতুন কূটনৈতিক উত্তেজনা স্পেনে বুনোলে ৮০তম টোমাটিনা উৎসব, ১২০ টন টমেটো ছোড়াছুড়িতে মেতে উঠলেন ২২ হাজার মানুষ শেরপুরে নারীর সামর্থ্য উন্নয়ন ও জলবায়ু অভিযোজন প্রযুক্তি নিয়ে কর্মশালা অনুষ্ঠিত

পুরো সমাজের ব্যর্থতা আর স্বামীর দায়িত্বহীনতা

সম্পাদকীয়
  • আপডেট সময় সোমবার, ৩০ জুন, ২০২৫
  • ৮৭ বার দেখা হয়েছে

এ দেশে ধর্ষণ নতুন নয়। নারী নির্যাতনও নয়। কিন্তু এই মুরাদনগরের ঘটনা নতুন করে প্রমাণ করল — এই দেশের মানুষ, সমাজ আর রাষ্ট্র ঠিক কতটা হীন, বিকৃত, নির্মম আর ভণ্ড হয়ে গেছে। যখন রাতের আঁধারে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে একজন নারীকে ধর্ষণ করা হয়, দুই শিশু ঘরে ঘুমন্ত। তারপর বিবস্ত্র করে মারধর করে। ভিডিও ধারণ করে। অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়। আর চারপাশের মানুষ উৎসবের মতো তা দেখে, শেয়ার করে, হাসাহাসি করে।

কুমিল্লার মুরাদনগরের সেই নারীর ঘটনার পর গোটা দেশের বিবেক নাড়া দিয়েছে। ধর্ষণ, নির্যাতন, ভিডিও ধারণ আর তা অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া — এই চারটি অপরাধই যখন এক সঙ্গে ঘটে, তখন বুঝতে আর বাকি থাকে না, আমরা কী ভয়াবহ মানসিক দৈন্যের সমাজে বাস করছি।

আরো একটি ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, ওই নারীর স্বামী এ ঘটনা শুনেও তাকে ফোন পর্যন্ত করে না! এই ঘটনা একদিকে যেমন ধর্ষকের পশুত্ব প্রকাশ করেছে, তেমনি আরেকদিকে সমাজের ভিতরে লুকিয়ে থাকা কাপুরুষ, দায়িত্বহীন স্বামীদের মুখোশ খুলে দিয়েছে। যে পুরুষ নিজের স্ত্রী ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরও খবর নেয় না, তাকে স্বামী বলা যায় না। তাকে মানুষও বলা যায় না। সে এক হিংস্র, বেহায়া, নিকৃষ্ট প্রাণী।

এ সমাজের আরেক ভয়াবহ রূপ হলো, নির্যাতনের শিকার নারীকে দ্বিতীয়বার খুন করা হয় — ভিডিও ছড়িয়ে, চরিত্র হননের মাধ্যমে। তার বাবাও বললেন, ‘আমার মেয়ের কোনো অপরাধ ছিল না। তবু ওর জীবন শেষ হয়ে গেল।’ এই সমাজ নারীদের জীবনের কোনো মূল্য রাখে না। শুধু শরীর আর ভোগের বস্তু মনে করে।

এ দেশে অপরাধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে নোংরা রাজনীতি। বিএনপি-আওয়ামী লীগ পাল্টাপাল্টি দোষারোপে মেতে ওঠে। অথচ আসল অপরাধ আড়াল হয়ে যায়। অপরাধীর কোনো দল থাকতে পারে না। অপরাধীর একটাই পরিচয় — সে নরপিশাচ।

আজ যখন সেই মা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমি মামলা তুলে নেব। সবাই মুক্তি পাক। আমি তো শেষ। আমি শুধু আমার দুইটা সন্তান নিয়ে বাঁচতে চাই।’ — তখন সেটা শুধু তার কান্না নয়। এ হলো এই রাষ্ট্রের, এই সমাজের ব্যর্থতার ঘোষণা। যেখানে ধর্ষণ শুধু শরীর নয়, সম্মানও কেড়ে নেয়। যেখানে বিচার পাওয়ার আশা করে একদিন একা এক নারী লড়াই করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

একজন স্ত্রী যখন নারকীয় নির্যাতনের শিকার হন, তার স্বামী সেই খবর শুনেও নিরুত্তাপ, তাকে ফোন পর্যন্ত করেন না — তখন প্রশ্ন উঠবেই, এই সম্পর্কের নাম কী? এ সমাজ যে নারীদের শুধু ঘরের কাজের লোক আর সন্তান জন্মদানের জন্য প্রয়োজন মনে করে, তার নগ্ন প্রমাণ মেলে এই ঘটনায়। স্বামী নামের মানুষটির এই অমানবিক নির্লিপ্ততা আসলে সমাজের অসংখ্য পুরুষের চরিত্রের প্রতিচ্ছবি।

স্বামী নামের মানুষটা তো সেই নারীর জন্য সবচেয়ে বড় আশ্রয় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে উল্টো মুখ ফিরিয়ে থাকে। এমন স্বামী হাজার হাজার আছে এ দেশে। যারা নারীর জীবনকে বোঝে না, নারীর দুঃখকে বোঝে না। বরং সমাজ কী বলবে — এই ভয়ে, কপট অহংকারে মুখ লুকিয়ে রাখে। এই স্বামীদেরও সামাজিকভাবে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

একজন নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর যখন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, স্বামী এ ঘটনা শুইনা আমারে ফোনও দেয় না। আমি দুটি শিশুসন্তান নিয়ে বাঁচতে চাই।’ — তখন তা শুধু তার জন্য নয়, এ দেশের পারিবারিক সম্পর্ক, পুরুষতন্ত্র এবং দায়িত্বশীলতার ভণ্ড মুখোশ খুলে দেয়। একজন স্বামীর প্রথম দায়িত্ব — স্ত্রী কোনো অন্যায়ের শিকার হলে তার পাশে দাঁড়ানো। তাকে সান্ত্বনা দেওয়া, শক্তি দেওয়া। সমাজের দোষারোপের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ানো। অভিযোগ-অপবাদ যাই আসুক, স্ত্রীর মর্যাদা রক্ষা করা। কিন্তু সেই দায়িত্ববোধ যখন হারিয়ে যায়, তখন শুধু ধর্ষক নয় — সমাজও অপরাধী। পরিবারও অপরাধী। আমরা যখন অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে লড়াই করি, ভিডিও ছড়ানোদের খুঁজতে ব্যস্ত হই — তখন এই স্বামী নামের মানুষটির দায়িত্বহীনতা চোখ এড়িয়ে যায়। এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ এটাই প্রমাণ করে, ধর্ষণের শিকার নারী শুধু অপরাধীর শিকার নন, বরং নিজের ঘর থেকেও অবহেলিত।

আজ তার সন্তান দুটো ঘরে ঘুমায়। মা একাকী কান্না করে। স্বামী পাশে নেই। সমাজ প্রশ্ন করে, ‘তুমি ঠিক ছিলে তো?’ তখন ভিকটিম একেবারে ভেঙে পড়ে। তাই সে বলে, ‘আমার যা হওয়ার হয়ে গেছে। সবাই মুক্তি পাক। আমি মামলা তুলে নেব।’ স্বামীর এই নিষ্ঠুরতা, দায়িত্বহীনতা অপরাধ না হলেও নৈতিক অপরাধ। নারীর প্রতি এই অবজ্ঞাই অপরাধীদের সাহসী করে তোলে।

পরিবারে নারীর মর্যাদা নিশ্চিত না হলে রাষ্ট্রে নারীর নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। শুধু অপরাধী নয়, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র — সবাইকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। সেই দিনই আসুক, যখন ধর্ষণের শিকার নারীকে মামলা তুলতে হবে না। স্বামী এড়িয়ে যাবে না। সমাজ বলবে না, ‘তুমি ঠিক ছিলে তো?’ বরং সবাই বলবে, ‘তুমি ভয় পেয়ো না, আমরা আছি।’

আমরা জানি, প্রশাসন গ্রেপ্তার করেছে। হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু এসব কাগুজে পদক্ষেপে কিছু হবে না। অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড ছাড়া এই দেশে ধর্ষণ বন্ধ হবে না। ভিডিও ছড়ানো পশুগুলোর সর্বোচ্চ সাজা না হলে সমাজ পাল্টাবে না।

আজ সময় এসেছে, এই জাতি কি মানুষ হবে, না পশু থাকবে — সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আর মুখে নারী দিবসের বুলি নয়। বরং সত্যিকারের নারী নিরাপত্তা চাই। নারীর পাশে থাকা স্বামী চাই, পরিবারকে চাই। সমাজের বিবেকবান মানুষ চাই। এ ঘটনার যারা শেয়ার করেছে, যারা চুপ থেকেছে, তারা প্রত্যেকেই অপরাধী। তাদেরও বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে।

শেয়ার করুন

Comments are closed.

এই ধরনের আরও নিউজ

© কপিরাইট ২০২৪-২০২৫ | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: NagorikIT