সাবেক সরকারের আমলে অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ একে একে খেলাপি হয়ে পড়ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা।
বর্তমানে বিতরণ করা মোট ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। এর মধ্যে শুধু জুলাই থেকে ডিসেম্বর—ছয় মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি
গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। তবে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে, অর্থাৎ ডিসেম্বরে, তা ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা বেড়ে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটিতে পৌঁছেছে।
এর আগে, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সরকারের সময় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যে ঋণ নেওয়া হয়েছিল, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের মধ্যে খেলাপির হার সেপ্টেম্বরে ছিল ৪০ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। একই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১১ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ হয়েছে।
কেন বাড়ছে খেলাপি ঋণ?
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নামে-বেনামে নেওয়া ঋণের প্রকৃত হিসাব এখন প্রকাশ করা হচ্ছে। এর ফলে ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
এ ছাড়া, বেক্সিমকো গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, সিকদার গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর ঋণও খেলাপি হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে শীর্ষ ১০ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে—বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, এননটেক্স গ্রুপ, মাইশা গ্রুপ, এফএমসি গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ, জাকিয়া গ্রুপ, রিমেক্স ফুটওয়্যার ও রাঙ্কা গ্রুপ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, খেলাপি ঋণ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে না। বরং নতুন তথ্য প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। ব্যাংক খাতে সুশৃঙ্খলতা ফেরাতে নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আগে ১৮০ দিন পর ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতো, এখন সেটি ৯০ দিনে নামিয়ে আনা হয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে—এমন তথ্য শুনতে শুনতে জনগণ ক্লান্ত। বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে, কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং কী পরিমাণ ঋণ আদায় হয়েছে। যদি কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে বোঝা যাবে, মূল সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।’
সব আমানতকারী টাকা ফেরত পাবেন
যদিও খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়ছে, তবু আমানতকারীরা তাদের টাকা ফেরত পাবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর।
তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমানত প্রবৃদ্ধি কম হওয়ায় কিছু ব্যাংকের তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে, যা সমাধানে নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এ জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক বন্ধ হলেও আমানতকারীরা তাদের জমাকৃত অর্থ ফেরত পাবেন।