আমার গল্প – ৪: ফেইসবুক কে ধন্যবাদ। বাংলাদেশিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
আমার এক সতীর্থ তার বাস্তব অভিজ্ঞতা মানুষের সাথে শেয়ার করেছেন। ওনার কিংবা আমাদের, অনেক আগেই এগুলি শেয়ার করা উচিত ছিল। আমরা করি নাই, করতাম না।
উনি অনেক কষ্ট থেকেই এই অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে প্রলুব্ধ হয়েছেন। দেশের জন্য আমাদের সেনা, আমাদের সৈনিক, আমাদের বিমান বাহিনী – চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস এ গত ৩৫ বছর যা করেছে, তা মানুষ জানে না। আমরা জানাইনি। মানুষকে জানতে দেওয়া হয় নাই। উলটা জানানো হয়েছে মিথ্যার ফুলঝুরি। যখন পার্বত্য মৃত্যু উপত্তাকায় দিনের পর দিন সৈনিক, আমার সৈনিক কষ্ট করেছে, যখন আমার বন্ধু ক্যাপ্টেন আলি এক ম্যালেরিয়াতে এক রাতেই মরে গেল, দেশ জানেনি। জানতে দেওয়া হয় নাই। বরং তাদেরকে জানানো হয়েছে আর্মি সইচ্ছায় পার্বত্য মৃত্যু ভূমিকে তাদের ট্রেইনিং গ্রউন্ড বানিয়েছে। এগুলি শুনেছি, কষ্ট পেয়েছি, চুপ থেকেছি আর কাজ করে গিয়েছি।
১৪ বার ম্যালেরিয়াতে ভুগেছি আমার ৩ (+/-) বছরের পার্বত্য জীবনে। আমার বন্ধুরা যখন সমতলে ঘুরে বেড়িয়েছে, আনন্দ করেছে, পড়াশুনা করেছে, দশ টাকার চা আর চপ খেয়েছে, আমি তখন আমার সৈনিকদের কে আমার পরিবার বানিয়েছি। আলুটিলা ক্যাম্পে এক অফিসার আর আমার ৩০ জন সৈনিক পরিবার মিলেমিশে এক হয়েছি। সারা দিন একা থেকেছি। এই সময় আমার সৈনিক, আমার পরিবার, একসাথে সকালে রুটি আর ভাজি খেয়েছি। রুটি খাবার আগে সেই রুটির সাথে জড়িয়ে থাকা দুর্ভাগা পোকা গুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আলাদা করেছি। প্রতি দিন পানি খেতে আমাদেরকে পানি প্যারেড হতো। সুউচ্চ পাহার থেকে নিচের ছড়াতে নামতে লাগতো ৩০/৪০ মিনিট। এক লাইন করে বালতি দিয়ে ছড়া থেকে পানি উঠানো হতো প্রতিদিন সকালে।
সেই পানি উঠানোর সময় চারপাশে অস্ত্র নিয়ে আমার সৈনিক দাড়িয়ে থাকতো যাতে করে গুলি না খেয়ে আবার কেউ মরে! প্রতিদিন ৩/৪ ঘণ্টা পানি প্যারেড করে সেই ছড়ার পানিতে রান্না হতো ভাজি, ডাল, ভাত আর শুটকি। সপ্তাহে একদিন খাবার সাপ্লাই আসতো আর সেই দিন মাংস কিংবা মাছ খাওয়া হতো। মাঝে মাঝে কোনও সুদিন উপলক্ষে (ঈদ) এক্সট্রা সাপ্লাই হতো। আমার থেকে অনেক বেশি কষ্টে ছিল আরও অনেকে। আমি মূলত সদরেই থাকতাম। তবে দুর্গম ক্যাম্পে যাওয়া হতো।
মৃত্যুর ঝুঁকি ছিল প্রতি মুহূর্তে। মাঝে মাঝে ভয় পেতাম। সেই ভয় লুকিয়ে রাখতে হতো। পেট্রলে আমার কিংবা অফিসারদের জায়গা পরিবর্তন করতে হতো কারন পাহাড়ি শান্তিবাহিনীর মুল লক্ষ ছিল অফিসারকে মারা। আমার আলুটিলা ক্যাম্পে যেতে সময় লাগতো আনুমানিক এক ঘণ্টা। পাহাড়ের উপর দিয়ে দুরের দীঘিনালা শহর এর আলো খুজতাম। রাত্রি ছিল ভয়ংকর। সেই ভয়ঙ্করের মাঝে অতীব অসাধারন সুন্দর কে খুঁজে নিতাম। আকাশে শাইমার ছবি আঁকতাম। কোনও একদিন আমি শাইমাকে বিয়ে করবো – ভালবাসবো – এই স্বপ্ন দেখতাম। মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তা করতাম, যদি মরে যাই তবে তো আর শাইমাকে পাওয়া হবে না! শাইমার জন্য বাচতে চাইতাম।
প্রতি রাত্রে আমার সৈনিক আর আমি পেট্রোল নিয়ে বের হতাম। এ পেট্রোল (৩০ জন), বি পেট্রোল (২০) কিংবা সি পেট্রোল (১০)। রাত্রে বি পেট্রোল ছাড়া কম বের হতাম। দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায় আমারা ২০ জন আমাবস্যার অন্ধকারে জঙ্গল আর এলিফেন্ট গ্রাসের মধ্য দিয়ে নিঃশব্দে হেটে যেতাম। অল্প শব্দ হলেই আমরা পজিশন নিতাম যদি শান্তিবাহিনী থাকে? গ্রাম থেকে গ্রামে যেতাম দুর্গম অঞ্চলে যেখানে সমতলের মানুষ যায় নাই কখনো। সাথে নিতাম মেডিসিন, কখনো চকলেট, বই ইত্যাদি ইত্যাদি। পথিমধ্যে (দিনে কিংবা সকালে) আমাদের উপজাতি ভাই বোন দের সাথে দেখা হলে এগুলি দিতাম। সকালে ক্যাম্পে ফিরে জোক প্যারেড করতাম।
আমি আর আমার সৈনিক মুখোমুখি দাঁড়াতাম। তারপর একে অন্যের শরীরের জোক গুলি ফেলতাম। রক্ত খেয়ে জোক মোটা হলে সরানো ইজি হতো। লবণের পানি ও লাগতো। আমি – আমার শরীরে এখনো জোকের কামড়ের দাগ নিয়ে চলছি। সপ্তাহে প্রতি দিন ক্যাম্পে ৩/৪ জন ম্যালেরিয়া জ্বরে ভুগত। আমরা নিজেরাই ডাক্তার হয়ে গেছিলাম। দুর্গম ক্যাম্পে ডাক্তার ছিল না। সিরিয়াস হলে তাকে ক্যাম্প থেকে সদরে দীঘিনালা গারিসনে পাঠাতাম। ক্যাম্পে আমাদের সময় ছিল স্থির। সারাদিন বসে বসে বই পড়তাম আর আমার সৈনিকের সাথে বসে তাস খেলতাম। সূর্য উঠত আর ডুবত।
রাত্রে তারা গুনতাম। পূর্ণিমার রাতে জ্যোৎস্নার আলোতে স্নান করতাম। রাত্রে এক পোস্ট থেকে অন্য পোস্টে যেতাম। সৈনিক – আমার একমাত্র আপন জনের সাথে গল্প করতাম যাতে তারা একা ফিল না করে। যাতে তারা বুঝে তাদের সার তাদের সাথে আছে। আত্মার সম্পর্ক এই সম্পর্ক। এটা বুঝার ক্ষমতা সমতলের অসুস্থ বিক্রিত বুদ্ধি বেবসায়িদের নাই।
এদেশের জন্য প্রতিটা সৈনিক, প্রতিটা অফিসার কি পরিমান সেক্রিফাইস করেছে তা বুঝলে এদেশের মানুষ শ্রদ্ধায় মাথা নত করতো। কিন্তু বিধি বাম। আমাদের মানুষকে জানতে দেওয়া হয় নাই।
তারপর?
সমতলে এসে শুনতাম আমরা পাহাড়ে নাকি নিজেদের ইচ্ছায় থাকি।
আমরা নাকি সইচ্ছায় পাহাড়ে ট্রেইনিং করি। কি অসাধারন ব্যপার! এমন উদ্ভট চিন্তা যে মানুষের মাথায় আসতে পারে তা আর্মিতে চাকরি না করলে জানতাম না।
আমার চাকরি ছাড়ার প্রথম চিন্তা মাথায় আসে পাহাড়ে চাকরি করার সময়।
যেই আমরা নিজের জীবন যৌবন উৎসর্গ করছিলাম এই দেশ রক্ষার প্রতিজ্ঞায় – সেই আমাদেরকেই বানানো হয় ভিলেইন!
যেই দেশে সৈনিক কে অসম্মান করা হয়, সেই দেশ সৈনিকের সেক্রিফাইস ডিজারভ কিভাবে করে ?
আজকে আমি মুগ্ধ। আপ্লূত। আজকে আমি অভিভূত। একটি পোস্ট শেয়ার করেছি। আমার লক্ষ্য ছিল মানুষ জানুক। সেই পোস্ট ১৬০০+ বার শেয়ার হয়েছে। মানুষ জানছে। সেই মানুষ, আমার বাংলাদেশি মানুষ যারা বুদ্ধি বিক্রি করে না, তারা তাদের কথা বলছে। সেই কথায় আছে ভালবাসা – সৈনিকের প্রতি শ্রদ্ধা। এটাই তো বাংলাদেশ। এমন বাংলাদেশ হোক প্রতিদিনের বাংলাদেশ।
এখানে উল্লেখ্য – পাহাড়ে আমার সতীর্থরা আমার থেকে অনেক বেশি কষ্ট করেছে। চিন্তা করে দেখুন এই পাহাড়ে পোস্টিং কে সিভিল সার্ভিসে পানিশমেন্ট পোস্টিং বলে। আর আমরা বছরের পর বছর – যুগের পর যুগ – এখানে দেশের জন্য আমাদের সেনাবাহিনী এই পোস্টিং কে জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়েছে। আমি যখন আমার সিভিল বন্ধুদের কাছ থেকে পানিশমেন্ট পোস্টিং এর গল্প শুনি – আমি হাসি। কিছু বলি না। এই পানিশমেন্ট পোস্টিং ই হলো আমাদের সৈনিকদের গলার মালা।
শেষ করছি একটি ঘটনা দিয়ে।
আমি তখন দীঘিনালা গারিসনে। আমরা দেশের নামকরা অভিনেতা সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী – তাদেরকে দুই কিংবা তিন দিনের সফরে দীঘিনালাতে আমন্ত্রন করেছি। তারা জানুক – দেশকে বলুক। মানে আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগন আমন্ত্রন জানিয়েছেন। আমি তখন পুঁটি মাছ। সদ্য লেফটেন্যান্ট মনে হয়। তাদেরকে আমরা ক্যাম্পে নিলাম। সব ঘুরে দেখালাম। তাদেরকে এতো যত্ন করেছি যাতে তাদের কষ্ট কম হয়। তারপরেও তাদের জীবন শেষ। তাও তাদের কোনও দুর্গম জায়গায় নেই নাই। একজন আমাকে বললেনঃ “বাবা আপনারা এতো কষ্ট করেন এটা জীবনেও বুঝি নাই।” আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়েছি। তাঁর এটুকু কথাই ছিল আমাদের চাওয়া।
যেদিন তারা চলে যাবেন তার আগের রাতে তাদের সম্মানার্থে রাত্রিতে নৈশ ভোজের ব্যবস্থা হলো। অতিথিকে যদি আপ্যায়ন করতে হয়, ডাল ভাত খাওয়ানো হয় না। আমরাও তাদেরকে পোলাও কোরমা খাওয়ালাম। এখন যদি আপনারা ওই একদিনের খাবার দেখে ভাবেন আর্মি তো ভালোই মৌজে আছে, তাকে কি বলবেন? আসলে শুটকি খাওয়ানোই উচিত হতো হয়তোবা!
যাই হোক, রাত্রিতে আমি তাদের সাথে কথা বলছি। একটা ফর্মাল ডিনার। সেই প্রথম আমি মনে হয় সামনা সামনি সেলিব্রিটি দেখলাম। এখন বুঝি তারা সেলিব্রিটি নন।
আমি এক সাংবাদিকের সাথে কথা বলছিলাম। তিনি আমাদেরকে মন থেকে ধন্যবাদ দিলেন। বড় সেলিব্রিটি বললেন আমরা নাকি “Son of the Soil”. গর্বে বুকটা ভরে গেলো। তিনি বিখ্যাত অভিনেতা। এখন গত হয়েছেন।
আমি এক পর্যায়ে সাংবাদিককে বললাম, আপনারা কি মানুষকে জানাবেন? আমাদের সৈনিকের কষ্টের কথা বলবেন?
সাংবাদিক চুপ। একটু থেমে বললেন,
“রিমন ভাই, আপনাকে মিথ্যা বলতে পারবো না। আপনাদের কষ্ট দেখে I can not lie to you. আপনারা যা করছেন, তা লিখে মানুষকে বুঝানো যাবে না।”
আমি শুনছি। অধীর আগ্রহে নিশ্চয়ই উনি লিখবেন।
আমরা তো লিখতে পারি না।
আমরা তো বলতে পারি না, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে প্রতিদিন যে হেলিকপ্টার নামে তাতে VIP আসে না। আসে গুলিবিদ্ধ সৈনিক কিংবা ম্যালেরিয়ায় ভোগা মৃত্যুপথযাত্রী আমাদের aponjon.
আমি যখন আর্মি তে জয়েন করি নাই, তখন ভাবতাম, এতো এতো VIP আসে এখানে? পরে যখন জানতে পারি ওই হেলিকপ্টারে VIP না, আসে আমাদের সেনাবাহিনীর লাশ কিংবা অসুস্থ রোগী – তখন লজ্জা পেয়েছি।
নিজের আমিত্বকে দিয়েছি ধিক্কার। চট্টগ্রামে বড় হয়েও কখনো বুঝিনি আমাদের সেনাবাহিনী কি না করেছে!
আমি যখন কাপ্তাই বেড়াতে গিয়েছি, ঘুণাক্ষরেও কি জেনেছি ওই রাস্তা নিরাপদ রেখেছে আমাদের সৈনিক আর অফিসার! কখনো কি ভেবেছি তারা রাস্তা পরিষ্কার করে, মাইন সুইপ করে নিজেদের কে রাস্তা থেকে অনেক দুরে লুকিয়ে রেখেছে?
আমি কি জেনেছি আমি যখন সুন্দর বিহনে স্নান করছি, দেশের ওই সৈনিক রাস্তার পাশে লুকিয়ে আমাদেরকে রক্ষা করছে যাতে করে শান্তিবাহিনী কোথাও থেকে আমাদেরকে আক্রমণ করতে না পারে?
যাই হোক, ফিরে যাই আমার সাংবাদিক ভাইয়ের কাছে।
তিনি বললেনঃ
“রিমন ভাই – আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি লিখতে চাইলেও আমাদেরকে লিখতে দেওয়া হবে না।”
“আমি সরি রিমন ভাই। আপনাদের কথা দেশের মানুষকে জানতে দেওয়া হবে না। আমাকে প্লিজ ক্ষমা করবেন”।
আমি শব্দহীন। আমার – আমাদের গল্প – সৈনিকের সেক্রিফাইসের কথা নাকি দেশকে জানতে দেওয়া হবে না। এডিটর তা প্রকাশ করতে দিবে না।
সেই রাত্রে আমি শব্দহীন ছিলাম। নিজের মনে একটা ঝড় বইছিল। আমার কানে এখনো তাঁর কথা বাজে। এ কোন দেশে আমি আছি? এ কেমন কথা? যেই মানুষগুলি দেশকে নিজের রক্ত দিয়ে প্রোটেক্ট করছে – তাদের কথা বলা যাবে না।
সেই প্রথম আমি চাকরি ছাড়ার কথা ভাবলাম।
আজ আমি সিভিলিয়ান। আমি বীরের কথা – আমাদের সৈনিকের কথা, আমাদের আর্মড ফোরস এর কথা অবলীলায় বলে যাই।
যদি কেউ পড়ে? আমি আমার মতো বিদ্রোহ করি বস্তা পচা দেশকে বিক্রি করা বুদ্ধিজীবিদের, সাংবাদিকের, পলিটিসিয়ান্দের বিরুদ্ধে।
আমি লিখি আমার জন্য – আমার বিবেকের টানে।
যদি কেউ আমাদের সেক্রিফাইসের কথা জেনে এই সেনাবাহিনীকে নিয়ে মিথ্যাচার করা বন্ধ করে!
আমি কান পেতে রই – আমি তাদের কথা, তাদের গল্প শুনতে চাই যাদের সেক্রিফাইসে বাংলা মায়ের মন গর্বে ভরে যায়।
কেউ জানুক আর না জানুক, আমার জন্ম ভূমি, আমাদের বাংলা মা ঠিকই জানে এদেশের মাটিতে কতো সৈনিকের রক্ত মিশে আছে।
আমারদের প্রতিটা সৈনিক, এক একজন বীর যোদ্ধা।
আমি বীরের কথা বলি।
Thanks to Facebook. Today we can talk about it. No more we have to rely on others to tell our story.
আর কি চাই?
লেখক: মেজর (অবঃ) রিমন মাহমুদ