বাংলাদেশে জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা হলো। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত সরাসরি জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য নির্মিত ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ চট্টগ্রাম–ঢাকা পাইপলাইন শনিবার (১৬ আগস্ট) আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে। এর ফলে মাত্র ১২ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকায় পৌঁছাবে ডিজেল, যা আগে নদীপথে ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগতো।
জ্বালানি উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খান পতেঙ্গায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার-ইন-চিফ মেজর জেনারেল মু. হাসান-উজ-জামান। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এবং কাজটি সম্পন্ন করেছে সেনাবাহিনীর ২৪ কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড।
বিপিসি জানায়, পাইপলাইন প্রকল্প চালুর ফলে বছরে অন্তত ৩০০ কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় হবে। বর্তমানে নদীপথে শতাধিক কোস্টাল ট্যাংকারে যে খরচ হতো, পাইপলাইনের মাধ্যমে পরিবহন ব্যয় কমে আসবে প্রায় এক-চতুর্থাংশে। আগে বছরে প্রায় ৩২৬ কোটি টাকা খরচ হতো, এখন খরচ হবে মাত্র ৯০ কোটি টাকা। এর ফলে বার্ষিক নেট সাশ্রয় দাঁড়াবে প্রায় ২৩৬ কোটি টাকা।
প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। ৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পর্যন্ত ২৪২ কিলোমিটার (১৬ ইঞ্চি ব্যাস) এবং সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত আরও ৮ কিলোমিটার (১০ ইঞ্চি ব্যাস)। পাশাপাশি কুমিল্লায় একটি নতুন ডিপো এবং সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লায় পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানির জন্য নতুন রিজার্ভার স্থাপন করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. আমিনুল হক জানান, এই পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রথমে রিফাইন ডিজেল পাঠানো হচ্ছে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা টার্মিনাল থেকে। সেখানে থেকে ডিজেল যাবে কুমিল্লা হয়ে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লার ডিপোতে। পরে এখান থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ডিপোতে সরবরাহ করা হবে।
প্রযুক্তিগত দিক থেকে প্রকল্পটি অত্যাধুনিক। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকেই পুরো পাইপলাইনের তেল সরবরাহ পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। সেন্ট্রাল অটোমেশন, টেলিকমিউনিকেশন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে ইতোমধ্যেই পাঁচ কোটি লিটার তেল সফলভাবে পরিবহন করা হয়েছে। জুন মাসে তিন দিনে ৩২ হাজার টন পরিশোধিত ডিজেল সরবরাহ করা হয়, যা কোনো ত্রুটি ছাড়াই সম্পন্ন হয়।
বিপিসি চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান জানান, পাইপলাইন চালুর ফলে দেশের জ্বালানি খাতে সময়, খরচ এবং পরিবহন ঝুঁকি বহুলাংশে হ্রাস পাবে। আগে নদীপথে ট্যাংকারে তেল আনার সময় দুর্ঘটনার ঝুঁকি ছিল, পাশাপাশি নদী দূষণের আশঙ্কাও থাকতো। পাইপলাইনের মাধ্যমে এ সমস্যা দূর হবে।
চট্টগ্রাম–ঢাকা পাইপলাইনকে বাংলাদেশের জ্বালানি সরবরাহ খাতে যুগান্তকারী প্রকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি শুধু সময় ও খরচ কমাবে না, বরং জ্বালানি সরবরাহকে করবে নিরাপদ, আধুনিক এবং পরিবেশবান্ধব। উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করল পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি সরবরাহের নতুন যুগে