বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ২০টি মিটারগেজ (এমজি) ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ কেনায় সহায়তা হিসেবে ১২৯ কোটি ৫৪ লাখ ডলার (প্রায় ১ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা) অনুদান দিচ্ছে চীন। পুরোনো লোকোমোটিভের কারণে দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংকট নিরসনে এ উদ্যোগকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা।
রেল মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে ‘চায়না গ্রান্টের আওতায় বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ২০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহ’ শীর্ষক প্রস্তাব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। দ্রুত অনুমোদনের জন্য প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (পিডিপিপি) কাজ এগিয়ে চলছে। পিডিপিপি অনুযায়ী, প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা (প্রায় ১৩৩ কোটি ১২ লাখ ডলার)। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা বহন করবে চীন এবং বাকি ৪৪ কোটি টাকা আসবে সরকারি তহবিল থেকে।
প্রকল্পটি ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২০২৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা আছে। এ সময়ের মধ্যে ২০টি লোকোমোটিভ সরবরাহ ছাড়াও খুচরা যন্ত্রাংশ ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশি প্রকৌশলী ও মেকানিকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে, যাতে প্রযুক্তি ও জ্ঞানের স্থানান্তর নিশ্চিত হয়।
রেলওয়ের বহরে বর্তমানে মোট ৩০৬টি লোকোমোটিভ আছে। এর মধ্যে ১৭৪টি মিটারগেজ ও ১৩২টি ব্রডগেজ। কিন্তু মিটারগেজ লোকোমোটিভের অধিকাংশই ২০ বছরের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল অতিক্রম করেছে। সরকারি নথি বলছে, মোট ১২৪টি এমজি লোকোমোটিভ, অর্থাৎ বহরের ৭১ শতাংশ নকশাগত আয়ুষ্কাল পার করেছে। এর মধ্যে ৬৮টি ইঞ্জিন চলছে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, আর ৮৪টি ব্যবহার হচ্ছে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে। প্রকৌশলীদের মতে, এত পুরোনো ইঞ্জিন সচল রাখা এখন ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। যন্ত্রাংশের ঘাটতি, আমদানির উচ্চ ব্যয়, ঘন ঘন বিকল হওয়া এবং জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় রেল সেবায় বড় ধরনের বিঘ্ন তৈরি হচ্ছে।
এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেন, পুরোনো ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের খরচ উৎপাদনক্ষমতার তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বেশি হয়ে পড়েছে। নির্ভরযোগ্যতা এতটাই কমে গেছে যে ট্রেন বিলম্ব ও বাতিল এখন প্রায় অনিবার্য। দ্রুত নতুন লোকোমোটিভ সংগ্রহ না হলে বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলের একাধিক রুটে মিটারগেজ সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
ওয়ার্কিং টাইম টেবিল অনুযায়ী, ২০২০ সালে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও লালমনিরহাট বিভাগে মিটারগেজ রুটে ২০৩টি লোকোমোটিভের প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে সক্রিয় আছে মাত্র ১৮২টি। অর্থাৎ অন্তত ২১টির ঘাটতি রয়েছে। বাস্তবে এই ঘাটতি আরও বেশি, কারণ গত পাঁচ বছরে যাত্রী ও মালবাহী পরিবহনের চাহিদা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে মালবাহী ও লোকাল ট্রেনে, যেগুলোকে অগ্রাধিকার না দিয়ে আন্তঃনগর সেবা চালু রাখা হচ্ছে। একই সঙ্গে সংকটের কারণে লোকোমোটিভ নিয়মিত ওভারহলও করা যাচ্ছে না, ফলে বিকল হওয়ার প্রবণতা আরও বেড়েছে।
সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রেলওয়ের যাত্রী পরিবহন অংশীদারিত্ব ১০ শতাংশে এবং মালবাহী পরিবহন ১৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য রেলওয়ে মাস্টার প্ল্যানে প্রথম ধাপে ৭৪টি প্রতিস্থাপনযোগ্য ও ৩৭টি নতুন লোকোমোটিভ কেনার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেনা হয়েছে মাত্র ৩০টি। ২০১১ সালে ৭০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ কেনার পরিকল্পনা অর্থসংকটে বাতিল হয়ে যাওয়ায় পুরোনো বহরের ওপর নির্ভর করেই রেল সেবা চালাতে হচ্ছে।
নতুন ২০টি চীনা লোকোমোটিভ এলে রেলওয়ের সেবা উন্নত হবে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা। এতে জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কমবে, ট্রেন চলাচলের নির্ভরযোগ্যতা বাড়বে এবং যাত্রী ও মালবাহী পরিবহনে নতুন সেবা চালু করা সম্ভব হবে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এ উদ্যোগ স্বস্তি দিলেও দীর্ঘমেয়াদে শুধু মিটারগেজ নয়, ব্রডগেজ লোকোমোটিভসহ পুরো বহরে আরও বড় বিনিয়োগ জরুরি। সময়মতো প্রতিস্থাপন না হলে রেলওয়ে নির্ভরযোগ্য পরিবহন খাত হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা হারাতে পারে।