কানাডার শান্ত ও বহুসংস্কৃতির পরিবেশে সম্প্রতি এক নতুন আতঙ্কের ছায়া নেমে এসেছে। ভারত থেকে পরিচালিত একটি শক্তিশালী সন্ত্রাসী ও অপরাধী সংগঠন ‘বিষ্ণয় গ্যাং’-এর ভয়াবহ কর্মকাণ্ড এখন কানাডার মাটিতেও বিস্তার লাভ করেছে। এই গ্যাং-এর বিরুদ্ধে কানাডায় একাধিক নৃশংস খুনের অভিযোগ উঠেছে, যা দেশটির অভিবাসী সম্প্রদায়, বিশেষ করে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের মধ্যে গভীর নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছে। এক সময় যারা উন্নত জীবন ও নিরাপত্তার খোঁজে কানাডাকে বেছে নিয়েছিলেন, আজ তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত। কানাডায় এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় এটিকে একটি ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করার দাবি উঠেছে, যা বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আল জাজিরার একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি, গ্যাংটির কার্যক্রম এবং ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা বিস্তারিত উঠে এসেছে।
বিষ্ণয় গ্যাং, যার নেতৃত্ব দেয় ভারতের কুখ্যাত অপরাধী লরেন্স বিষ্ণয়, প্রাথমিকভাবে ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান এবং দিল্লিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই গ্যাং মূলত চাঁদাবাজি, অপহরণ এবং ভাড়াটে খুনের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য পরিচিত। ভারতের অভ্যন্তরে এই গ্যাং-এর নৃশংসতা বহু পুরনো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের কর্মকাণ্ডের পরিধি আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে কানাডাতেও বিস্তৃত হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কানাডায় এই গ্যাং-এর কার্যক্রম মূলত প্রবাসী ভারতীয়দের নিশানা করে পরিচালিত হয়। তারা বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে তাদের উপর হামলা চালানো হয় বা পরিবারের সদস্যদের হুমকি দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত বিরোধের কারণেও তারা চুক্তিভিত্তিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত। কানাডার মাটিতে এমন অপরাধমূলক কার্যকলাপ পরিচালনা করতে তারা দেশের অভ্যন্তরে থাকা তাদের সহযোগী এবং বিদেশে থাকা নেটওয়ার্কের সুবিধা নেয়, যা স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে এই হুমকি মোকাবিলায় কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই গ্যাং-এর সদস্যরা প্রায়ই সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে তাদের অপরাধের দায় স্বীকার করে এবং ভুক্তভোগীদের হুমকি দেয়, যা তাদের ক্ষমতা ও প্রভাবের প্রকাশ ঘটায়।
বিষ্ণয় গ্যাং-এর দ্বারা সংঘটিত বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কানাডায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিষ্ণয় গ্যাং-এর অন্যতম শিকার ছিলেন হরজিত সিং। তিনি কানাডায় একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গ্যাং-এর সদস্যরা তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। যখন তিনি এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন, তখন তাকে এবং তার পরিবারকে লাগাতার হুমকি দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে তার উপর ১৯ মে কানাডার মিসিসাউগায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে ২০২৩ সালে খালিস্তান আন্দোলনের নেতা হরদিপ সিং নিজ্জার হত্যাকান্ডে স্বীকারক্তি দেয় বিষ্ণয় গ্যাং। চলতি বছরের জুনে কানাডার ব্যবসায়ী সতীন্দর শর্মা এবং এমপি ধানোয়া নামক দুই ব্যক্তিকে গুলি করার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি।
এই ভুক্তভোগীদের পাশাপাশি, প্রতিবেদনে অন্যান্য অভিবাসীদের মতামতও তুলে ধরা হয়েছে, যারা এই গ্যাং-এর ভয়ে সিঁটিয়ে আছেন। একজন পাঞ্জাবি রেস্তোরাঁ মালিক বলেন, “আমরা জানি না কখন আমাদের দরজায় এসে তারা চাঁদা চাইবে। যদি আমরা না দিই, তাহলে আমাদের উপর কী ঘটবে, তা ভাবতেও ভয় লাগে।” আরেকজন অভিবাসী বলেন, “এই ধরনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আমাদের স্বপ্নের কানাডাকে একটি আতঙ্কের দেশে পরিণত করছে। সরকার যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।”
কানাডায় বিষ্ণয় গ্যাং-এর ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবিলায় এটিকে একটি ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করার দাবি জোরালো হচ্ছে। কানাডীয় আইন অনুযায়ী, কোনো সংগঠনকে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করা হলে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা সম্ভব হয়, তাদের সম্পদ জব্দ করা যায় এবং তাদের সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি আরোপ করা যায়।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডীয় রাজনীতিবিদ এবং বিরোধী দলের নেতারা এই দাবি তুলেছেন। তারা বলেন যে, এই গ্যাং-এর কার্যকলাপ কেবল সাধারণ অপরাধ নয়, বরং এটি কানাডার জাতীয় নিরাপত্তা এবং সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুতর হুমকি। তাদের মতে, এই গ্যাং-এর কার্যকলাপ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে, কারণ তারা ভয় ও সহিংসতা ব্যবহার করে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করে।
কানাডীয় পুলিশ এই গ্যাং-এর বিরুদ্ধে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের চ্যালেঞ্জ অনেক। এই গ্যাং-এর সদস্যরা প্রায়ই ছদ্মবেশে কাজ করে এবং তাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের কারণে তাদের চিহ্নিত করা ও ধরা কঠিন হয়ে পড়ে। উপরন্তু, তারা ভারতের অপরাধী গোষ্ঠী এবং কানাডায় থাকা তাদের সহযোগীদের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করে, যা তাদের কার্যকলাপকে আরও জটিল করে তোলে।
কানাডার সরকার যদি এই গ্যাংকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে, তাহলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া এবং তাদের সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে। একই সাথে, অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরাপত্তার অনুভূতি ফিরে আসবে এবং তারা নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারবে।
বিষ্ণয় গ্যাং-এর এই উত্থান একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোনো দেশই বিচ্ছিন্ন নয়। ভারত ও কানাডার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্যের আদান-প্রদান এবং আইনি সহযোগিতা আরও জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি। এই হুমকির মোকাবিলায় শুধু কানাডীয় সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়, বরং পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা প্রয়োজন, যাতে এই ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মূল উৎপাটন করা যায় এবং নিরপরাধ মানুষের জীবন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।