প্রতিহিংসার রাজনীতি না উন্নয়ন: কোন পথে বাংলাদেশ? - দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ
নোটিশ:
শিরোনামঃ
প্রতিহিংসার রাজনীতি না উন্নয়ন: কোন পথে বাংলাদেশ? ঈদে রেমিট্যান্সের জোয়ার: ৩ দিনে ৭ হাজার কোটি টাকা দেশে পাঠালেন প্রবাসীরা। বেড়েছে রিজার্ভ। ৫৫ মাসের নীরবতা ভেঙে ফিরল সেই পুরোনো ফুটবল — ‘বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!’ গর্জালো জাতীয় স্টেডিয়াম বিশ্বজুড়ে লাখো মুসলমান মক্কায়, শুরু হলো পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীনদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল হয়নি, গুজব উড়িয়ে দিলো সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে জোর জামালপুর থেকে ঢাকায় কোরবানির গরু নিতে ক্যাটল স্পেশাল ট্রেন, ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি নির্বাচন পেছানোর কোনো প্রয়োজন নেই, এক মাসেই জরুরি সংস্কার সম্ভব: সালাহউদ্দিন আহমেদ নোবিপ্রবিতে গবেষণা তহবিলের ৪৩ লাখ টাকা আত্মসাত , কম্পিউটার অপারেটর সাময়িক বরখাস্ত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নামে গণহত্যা! শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ – গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

প্রতিহিংসার রাজনীতি না উন্নয়ন: কোন পথে বাংলাদেশ?

মো: রবিউল ইসলাম, ক্যাম্পাস প্রতিনিধি, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর।
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৫ জুন, ২০২৫
  • ৪৪ বার দেখা হয়েছে

স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে স্থায়ী বাস্তবতাটি যেন হয়ে উঠেছে প্রতিহিংসা। ক্ষমতার পালাবদলে এদেশের রাজনীতিতে ঘুরেফিরে দেখা যায় একই দৃশ্যপট—একটি দল ক্ষমতায় থাকলে অপর দলকে নিঃশেষ করতে যেন তৎপর হয়ে ওঠে।প্রতিহিংসার রাজনীতি এদেশে নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই ধারার শিকড় দৃঢ় হয়েছে। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস, মামলা, গ্রেপ্তার, দলীয় প্রশাসন কিংবা মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ—এসব যেন রাজনীতির অনিবার্য অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে। এক দল ক্ষমতায় গেলে অন্য দল হয়ে পড়ে ‘রাষ্ট্রের শত্রু’। গণতন্ত্রের নামে চলে একচেটিয়া শাসন, যেখানে ‘সমালোচনা’ মানে ‘ষড়যন্ত্র’।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমানকে৷ এরপর সামরিক বাহিনীর প্রধান জিয়াউর রহমান শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়ে সাংবিধানিকভাবে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার পাওয়ার পথ বন্ধ করে দেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যত্থানে নিহত হন৷ এরপর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিএনপির সাত্তার সরকারকে হটিয়ে তখনকার সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন৷ গণঅভ্যুত্থানে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন হয়৷ এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে নিজের রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি গঠন করেন৷ এরশাদকে হটাতে ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একইসঙ্গে আন্দোলন করে৷ পরবর্তীতে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে৷ ওই নির্বাচন হয় সবদলের সমর্থনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে৷

কিন্তু ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে একতরফাভাবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে৷ ভোটারবিহীন ঐ নির্বাচন আওয়ামী লীগসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্জন করে৷ নির্বাচনে জিতে বিএনপি সরকার গঠন করলেও তা স্থায়ী হয় না৷ আন্দোলনের মুখে বিএনপি সংসদে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন পাশ করে সেই বছরেরই ১২ জুন নতুন নির্বাচন দেয়৷ সেই নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২১ বছর পর আবার সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ৷ এরপর ২০০১ সালের ১ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে৷ ২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের সময়টা ছিল ঘটনাবহুল৷ তার আগে ক্ষমতাসীন বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে তখনকার রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে৷ কিন্তু আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদত্যাগ করে৷ সেনা সমর্থনে ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, যা এক-এগারোর সরকার নামে পরিচিত৷ ওই সময়ে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া উভয়কেই কারা অন্তরীণ করা হয়৷ পরে অবশ্য তাঁদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তখনকার সরকার।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে৷ ঐ মেয়াদে আদালতের রায়ের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়৷ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি-জামায়াত ওই নির্বাচন বর্জন করে৷ তারা নির্বাচন প্রতিহতেরও ঘোষণা দেয়৷ একতরফা নির্বাচনে জয়ের পর আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় বারের মত ক্ষমতায় আসে।
২০১৪ সালের মতো ২০১৮ সালেও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ-সংশয় ছিল। নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে আরও কিছু দল যুক্ত হয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ আরও কিছু দল ও জোটের সঙ্গে সংলাপ করেন এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেন। এ রকম প্রেক্ষাপটে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। তারপর ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিতর্কিত এ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ছয় মাসের মাথায় পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। গণআন্দোলনের মুখে ২০২৪ সালের ৫ই অগাস্ট ভারতে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত সরকার প্রধান শেখ হাসিনা।

ক্ষমতার এই পালাবদলে দুটি দল দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে একাধিকবার। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী গুম , হত্যার মতো অপরাজনীতি চলছে বহু কাল। দখলদারিত্ব এবং চাঁদাবাজিতে যেন পিছিয়ে নেই কেউ।অবশ্য একইসঙ্গে এটাও সত্য, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, বিদ্যুৎ খাতে অগ্রগতি এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ—এসবই উন্নয়নের দৃশ্যমান প্রমাণ। দেশে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এ উন্নয়ন কি টেকসই, যদি রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি হয় প্রতিহিংসাপ্রবণ?

একটি রাষ্ট্র কেবল রাস্তা, সেতু বা বিদ্যুৎ উৎপাদন দিয়ে এগোয় না—গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক সহনশীলতা ছাড়া উন্নয়ন হয় অগভীর ও দুর্বল ভিতের ওপর দাঁড়ানো। যখন বিরোধীদল নির্বাচনে অংশ নিতে ভয় পায়, বা অংশ নিলেও সমান সুযোগ পায় না—তখন গণতন্ত্র থাকে নামমাত্র। রাজনৈতিক শত্রুতার কারণে দেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজ রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফলে রাজনীতির ময়দান ফাঁকা হয়ে যায়। রাজনীতি চলে যায় চাটুকার ও ক্ষমতালোভীদের দখলে। প্রশ্ন উঠছে—এই প্রতিহিংসার বৃত্ত থেকে আমরা কীভাবে বের হবো? পরিবর্তন কি কেবল সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে, নাকি জনগণের সচেতনতা, সুশীল সমাজের সক্রিয়তা, মিডিয়ার স্বাধীন ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হবে?

যতদিন না রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় প্রভাবমুক্ত হবে, ততদিন সুষ্ঠু নির্বাচন বা ন্যায়বিচার আশা করা কঠিন। রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে, বিরোধী দল থাকা

মানে গণতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা হওয়া। যে দল ক্ষমতায় আছে, তাকে একদিন বিদায় নিতে হবে—এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। অথচ আমরা সেই শিক্ষা ভুলে গিয়েছি বারবার। দলমত নির্বিশেষে রাজনীতিতে যদি সংলাপ, বোঝাপড়া ও সহনশীলতা ফিরিয়ে না আনা যায়, তবে উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য কখনোই পৌঁছানো সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের ওপর। প্রতিহিংসার এই অচলায়তন ভেঙে একটি অংশগ্রহণমূলক, ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির চর্চা শুরু করতে না পারলে, আমরা উন্নয়নের পরিসংখ্যান দেখিয়ে আত্মতুষ্ট হতে পারি—কিন্তু ভেতরে থাকবে শূন্যতা, উদ্বেগ আর আস্থাহীনতা।

প্রয়োজন এখন একটি নতুন ধারার রাজনীতি—যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে, কিন্তু শত্রুতা নয়; মতভেদ থাকবে, কিন্তু দমন নয়। উন্নয়ন আর গণতন্ত্র—দুটির মধ্যে যে ভারসাম্য রক্ষা করবে, তারাই হবে আগামী দিনের সত্যিকারের নেতৃত্ব।

মোঃ রবিউল ইসলাম
শিক্ষার্থী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

শেয়ার করুন

Comments are closed.

এই ধরনের আরও নিউজ

© কপিরাইট ২০২৪-২০২৫ | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: NagorikIT