বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে শৃঙ্খলা, নিয়ম-শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনধারা এবং ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে সাধারণ মানুষের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যখন জনগণের আস্থা হারিয়েছে, তখন সেনাবাহিনী একটি দৃঢ় এবং নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে মানুষের আস্থা ধরে রেখেছে। কিন্তু যদি কখনও সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্ব জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে শুরু করে, তাহলে তা হবে দেশের জন্য এক ভয়াবহ সংকট।
১. জনগণের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দূরত্ব সৃষ্টি: বাংলাদেশের ইতিহাস বলে যে, জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো শাসন শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনি। সেনাবাহিনী যদি কোনো প্রত্যাখ্যাত ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করে, তাহলে সাধারণ জনগণের মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রতি ক্ষোভ তৈরি হবে। একসময়ে যে প্রতিষ্ঠান মানুষ মনে করত তাদের রক্ষাকবচ, সেটিই যদি প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে জনগণ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে এক ধরণের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হবে, যা দেশের জন্য মোটেও ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
২. সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সাধারণত প্রায় সবসময়ই রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ থাকার জন্য প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু যদি এটি ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসনের একটি হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তাহলে এর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সেনাবাহিনীর শক্তি জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকার জন্য, কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা পরিবারের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য নয়। যদি এমন হয় যে সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্ব নিজেদের স্বার্থে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষ নেয়, তাহলে জনগণের মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রতি যে শ্রদ্ধা ও আস্থা ছিল, তা খুব দ্রুতই নষ্ট হয়ে যাবে।
৩. রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে: যেকোনো রাষ্ট্রে সামরিক বাহিনী একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি, যা দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষা করে। কিন্তু যদি এই প্রতিষ্ঠান ফ্যাসিবাদী স্বার্থে ব্যবহৃত হয়, তাহলে দেশের স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে। সেনাবাহিনীর ভূমিকা যদি জনগণের স্বার্থবিরোধী হয়ে ওঠে, তাহলে এটি অস্থিতিশীলতা, বিশৃঙ্খলা এবং সংঘাতকে উৎসাহিত করতে পারে।
৪. আন্তর্জাতিক চাপ ও নিন্দার সম্মুখীন হবে দেশ: আমরা জানি যে পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনার সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ব্যাপারে জাতিসংঘ থেকেও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে সামরিক বাহিনী যদি সেই ফ্যাসিস্টের পুনর্বাসনের কাজে লিপ্ত হয় এবং জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে, তাহলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও সমালোচিত হবে। সেক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক চাপ এবং বৈদেশিক সাহায্য ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
৫. ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীর একতা ও শৃঙ্খলা বিনষ্ট: আমরা জানি যে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় হাসিনা চেষ্টা করেছিলো সেনাবাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে। টপ ব্র্যাস হয়তো রাজিও ছিলো, কিন্তু মিড ও লোয়ার মিড অফিসারদের বিপরীত মনোভাব টের পেয়ে টপ ব্রাস বাধ্য হয়ে হাসিনার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। সুতরাং এখন যদি আবার সেই পতিত ফ্যাসিস্টের পূনর্বাসনের কাজে সেনাশক্তিকে ব্যবহার করা হয় তাহলে সেই মিড ও লোয়ার মিড অফিসারদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাধাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে এটি সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারে। সেনাবাহিনীর মধ্যে যদি মতাদর্শগত বিভাজন সৃষ্টি হয়, তাহলে সেটি বাহিনীর কার্যকারিতা এবং ঐক্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের বাহিনী, কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নয়, কোনো ফ্যাসিস্টের তো নয়ই। তাই সেনাবাহিনীকে অবশ্যই জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং রাজনৈতিক পক্ষপাত এড়িয়ে চলতে হবে। যদি কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা পতিত ফ্যাসিস্টের পুনর্বাসনে ভূমিকা রাখতে চান, তবে তাদের অবশ্যই বোঝা উচিত যে, এটি কেবল সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তির ক্ষতি করবে না, বরং এটি দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সেনাবাহিনীকে তার আদর্শ, নৈতিকতা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে, নতুবা ভবিষ্যতে দেশ আরও বড় সংকটের সম্মুখীন হতে পারে।
লেখক: আহমেদ রফিক (সিয়ান পাবলিকেশন প্রধান)