বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এক শিক্ষার্থীর ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। তানভীর সুমন নামের ওই শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন যে, ভাইভা পরীক্ষার সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা একজন অতিথি শিক্ষক নূরুল কাইয়ুম একজন নারী শিক্ষার্থীকে তার নিকাব খুলতে বাধ্য করেছেন। এই ঘটনা শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকা এবং তাদের নীরবতা নিয়েও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
তানভীর সুমনের ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যায়, ভাইভা শুরুর আগেই সেমিনার রুমে ছাত্রীদের বলা হয়েছিল যে, কেউ যেন নিকাব পরে ভাইভা রুমে প্রবেশ না করে। ভাইভা চলাকালীন সময়ে কয়েকজন ছাত্রী নিকাব পরেই প্রবেশ করলে তাদের নিকাব খুলতে বাধ্য করা হয়। এই নির্দেশটি মূলত দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা শিক্ষক নূরুল কাইয়ুম, যিনি ভাইভার এক্সটার্নাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগটি হলো, যখন একজন ছাত্রী নিকাব খুলতে অস্বীকৃতি জানায়, তখন তাকে ‘জিরো মার্কস’ দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এই হুমকিটি দিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ইউসুফ। পোস্টটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভাইভা কক্ষে কোনো নারী শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন না, যার ফলে ছাত্রীদের জন্য পরিস্থিতি আরও বিব্রতকর হয়ে ওঠে। এই ঘটনায় স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, একজন শিক্ষার্থীর ধর্মীয় অধিকারকে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং তাকে তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
এই ঘটনার সবচেয়ে হতাশাজনক দিকটি হলো, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষকরা এই অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে উল্টো তা সমর্থন করেছেন। তানভীর সুমনের পোস্ট অনুযায়ী, যখন বহিরাগত শিক্ষক নূরুল কাইয়ুম নিকাব খুলতে বাধ্য করছিলেন, তখন ক্যাম্পাসের অন্য শিক্ষকরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাদের কেউই এই কাজের বিরোধিতা করেননি বা ছাত্রীর পাশে দাঁড়াননি। বরং, বিভাগীয় শিক্ষক ইউসুফ উল্টো হুমকি দিয়েছিলেন যে নিকাব না খুললে ওই শিক্ষার্থীকে ‘জিরো’ দেওয়া হবে।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জানান, “আমি ভাইভা রুমে গিয়ে বসার সাথে সাথে এক্সটার্নাল পরীক্ষক বললেন ‘মুখ খুলো’। আমি বললাম, স্যার আমি এভাবেই আসি, অভ্যস্ত এভাবেই, খুলতে সমস্যা আছে। তখন তিনি বললেন, ‘এটা কোনো নিয়ম না, এটা অভদ্রতা।’ উপস্থিত এক শিক্ষক বলেন, ‘তুমি তো চাকরি করতে চাইবে? এভাবে গেলে চাকরি দেবে?’ আরেকজন বলেন, ‘এখানে আসার আগে তোমার প্রিপারেশন নেওয়া দরকার ছিলো, নিয়ম মানতে হবে।’ আমি জানালাম যে ভেতর থেকে দেয়া নিকাব খোলা যাবে না। তখন এক্সটার্নাল আবার বললেন, ‘তুর্কি, ইরানি, আফগান মেয়েরা কি ইসলাম মানে না? ওরা কি এভাবে থাকে?’ শেষে রুম থেকে বের হওয়ার সময়ও আমাকে সতর্ক করে বললেন, ‘পরের বার এভাবে আসবে না।’ আরেকজন শিক্ষক বের হওয়ার পথে বলেন, ‘তোমার এই ড্রেসকোডের জন্য শূন্য নম্বর পাবা।’ আমি এতটাই নার্ভাস ছিলাম যে সব কথাই মনে নাই।”
এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি উদাসীন। একজন শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব হলো তার শিক্ষার্থীদের সম্মান ও অধিকার রক্ষা করা, কিন্তু এক্ষেত্রে তারা কেবল নীরব দর্শকই ছিলেন না, বরং হুমকির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে এই অন্যায়কে সমর্থনও করেছেন। এটি একটি গুরুতর অভিযোগ, যা শুধু ওই বিভাগের শিক্ষকদের নৈতিকতা নিয়েই নয়, বরং পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার মূল্যবোধ নিয়েও প্রশ্ন তোলে।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে এবং সে তার পছন্দ অনুযায়ী ধর্ম পালন করতে পারবে। এই ঘটনার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কেবল জ্ঞান বিতরণের কেন্দ্র হিসেবে দেখা হয় না, বরং এটি এমন একটি স্থান যেখানে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত অধিকার, সম্মান এবং স্বাধীনতার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা দেখানো হয়। কিন্তু এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানেও কিছু শিক্ষক ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে সংবেদনশীলতা দেখাচ্ছেন না। এই ধরনের ঘটনা শুধু শিক্ষার্থীদের মানসিক আঘাতই দেয় না, বরং দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তির জন্যও হুমকিস্বরূপ। কর্তৃপক্ষকে এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা উচিত এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
তানভীর সুমনের এই ফেসবুক পোস্টটি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া একটি গুরুতর ঘটনার চিত্র তুলে ধরে। এটি শুধু একটি একক ঘটনা নয়, বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত অধিকারের প্রতি উদাসীনতার এক উদাহরণ। নূরুল কাইয়ুমের মতো বহিরাগত শিক্ষক কর্তৃক নিকাব খুলতে বাধ্য করা এবং নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সমর্থন, এই উভয় ঘটনাই প্রমাণ করে যে, এই ধরনের সংবেদনশীল ইস্যুতে আমাদের সমাজে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরও সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। যদি শিক্ষকরাই এমন আচরণ করেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকারের জন্য কোথায় যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।