দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা লালমনিরহাট বিমানবন্দরকে ঘিরে এবার নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। উত্তরাঞ্চলের এই পুরনো অবকাঠামোটি সচল করতে মাঠে নেমেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, শুধু উত্তরাঞ্চল নয়, এই বিমানবন্দর চালু হলে তা হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার একটি আঞ্চলিক বিমান চলাচল ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ হাব।
১৯৩১ সালে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হয় এই বিমানবন্দরটি। প্রায় ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ রানওয়ের জন্য একসময় দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম সামরিক অবকাঠামোর মধ্যে এটি অন্যতম ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরে এটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। তবে সম্প্রতি লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক একটি চিঠির মাধ্যমে বিমানবন্দরটি পুনরায় চালুর জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান। সেই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এবার বিষয়টি বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে।
বেবিচকের চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত অফিস আদেশ অনুযায়ী, লালমনিরহাট বিমানবন্দর সচল করতে যে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারা রানওয়ে, টার্মিনাল, বোর্ডিং ব্রিজ, কন্ট্রোল টাওয়ার, কার্গো ভবন, ফায়ার স্টেশনসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর স্থান নির্ধারণ, যন্ত্রপাতির সম্ভাব্য অবস্থান নিরূপণ এবং কারিগরি সমীক্ষার বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়ার সুযোগও থাকবে কমিটির হাতে।
কারিগরি কমিটির প্রধান হিসেবে রয়েছেন বেবিচকের সদস্য (এটিএম) মো. নূর-ই-আলম এবং সদস্য সচিব বেবিচকের পরিচালক (এটিএম) মো. শামসুল হক। ইতোমধ্যে তারা বৈঠক করে কার্যক্রম শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। প্রাথমিকভাবে কিছু জমি বেবিচকের দখলে থাকলেও কিছু জমি অন্যান্য সংস্থার অধীনে রয়েছে, যেগুলো নিয়ে কাজ চলছে।
এদিকে, ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি গত মে মাসে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায়, লালমনিরহাট বিমানবন্দর চালুর পরিকল্পনায় ভারত সতর্ক হয়ে উঠেছে। কারণ, এটি ভারতের ‘চিকেন নেক’ হিসেবে পরিচিত সংবেদনশীল পূর্বাঞ্চলীয় করিডোর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে। ভারতের পক্ষ থেকে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, এই প্রকল্পে চীনা সামরিক বা বাণিজ্যিক সংযোগ তৈরি হতে পারে। এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ত্রিপুরার কৈলাশহরে একটি পুরনো বিমানঘাঁটি পুনরায় চালুর পরিকল্পনা করছে।
তবে এসব ভূরাজনৈতিক চাপের মধ্যেও বাংলাদেশ সরকার লালমনিরহাট বিমানবন্দর চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। বেবিচক জানিয়েছে, গত মাসে তারা জমি সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তাতে দেখা গেছে, বিমানবন্দরের প্রায় ১ হাজার ১৫৯ একর জমি প্রতিরক্ষা বিভাগের নামে রেকর্ডভুক্ত। এখন সেগুলোকে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নামে স্থানান্তরের জন্য আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া হবে।
সাবেক বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, “আমি দায়িত্বে থাকাকালে এই বিমানবন্দর চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এটি চালু হলে চিলমারী নদীবন্দরসহ পুরো উত্তরাঞ্চলের উন্নয়ন বহুগুণে তরান্বিত হবে। পার্শ্ববর্তী নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ তৈরি হবে।” তিনি মনে করেন, বিমানবন্দরটি দক্ষিণ এশিয়ার একটি ব্যবসা হাবে পরিণত হতে পারে।
বর্তমান বেবিচক সদস্য এয়ার কমোডর মোহাম্মদ মেহবুব খান জানান, ৫ সদস্যের কারিগরি কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধার যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে এই বিমানবন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে সোনাহাট ও বুড়িমারী স্থলবন্দরের কার্যকারিতা বাড়বে, আন্তর্জাতিক ইপিজেড বাস্তবায়ন সহজ হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটনে উত্তরাঞ্চল নতুন মাত্রা পাবে।
বিশেষ করে যে বিষয়টি আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে, তা হলো- বিমানবন্দর চালু করতে নতুন করে ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে না। পুরনো রানওয়ে, হ্যাঙ্গার, ট্যাক্সিওয়ে ও টারমাক এখনও মূলত অক্ষত রয়েছে, যা সংস্কার করলেই কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব।