গাজার শিশুরা আজ খাবার না পেয়ে মারা যাচ্ছে, হাসপাতালগুলো ধ্বংসস্তূপ, আর হাজারো মানুষ জীবন্ত পোড়া লাশে পরিণত হচ্ছে। অথচ এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেই কিছু বহুজাতিক কোম্পানি কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা করছে—তাও সরাসরি এই হত্যাযজ্ঞে সহায়তা করে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রান্সেসকা আলবানিজ গত ৩০ জুন এক বিস্ফোরক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। সেখানে ৪৮টি আন্তর্জাতিক কোম্পানিকে স্পষ্টভাবে নাম করে বলা হয়েছে, এরা ইসরায়েলের দখলদার নীতি, গাজায় চলমান আগ্রাসন এবং ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর নজরদারি ও নিপীড়নকে প্রযুক্তি, অস্ত্র ও অর্থের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে সমর্থন দিচ্ছে।
তিনি বলেন, “এটা শুধু দখল নয়, এটা এখন একটা গণহত্যার অর্থনীতি।” (UN OHCHR, 2024)
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, লকহিড মার্টিন, রেথিয়ন (RTX), জেনারেল ডায়নামিকস সহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি ইসরায়েলের সামরিক ষড়যন্ত্রে জড়িত। লকহিড মার্টিন এখনও পর্যন্ত ইসরায়েলকে প্রায় ৩৯টি F‑35 যুদ্ধবিমান সরবরাহ করেছে, যেখানে প্রতি বিমান গড়ে ৯০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। প্রতিবছর গড়ে এক বা দুইটি নতুন বিমান গাজার দিকে যাচ্ছে। বছরে প্রায় ৭১ বিলিয়ন ডলার এই কোম্পানির মোট আয়, যার বড় অংশ আসে অস্ত্র রপ্তানি থেকে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার ‘হেলফায়ার’ মিসাইল, BLU‑109 ধ্বংসাত্মক বোমা — যা হাসপাতাল, স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্রে হামলার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এসব কোম্পানি এত নিঃস্বার্থভাবে খুনকে উপভোগ করছে যেন এটাই তাদের প্রধান ব্যবসা।
মাইক্রোসফট, গুগল (অ্যালফাবেট), অ্যামাজন ও আইবিএম ফিলিস্তিনিদের ওপর নজরদারি করার জন্য ইসরায়েলের প্রশাসনকে সম্পূর্ণ ক্লাউড সার্ভিস ও এআই ভিত্তিক সেবা দিচ্ছে। আইবিএম ফিলিস্তিনি নাগরিকদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করছে, যা ব্যবহার করে তাদের চলাচল ও জীবন নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। পালানটির এর সফটওয়্যার সরবরাহ করেছে এমন এআই ভিত্তিক সেবা, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘টার্গেট’ তালিকা প্রস্তুত করে — ফলে কে বাঁচবে এবং কে মরবে তা নির্ধারণে মানুষই নেই, কম্পিউটারই সকল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এই প্রযুক্তি যে শুধু ব্যবসা নয়, এটি এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের অংশ।
গণহত্যাই জড়িত কোম্পানিদের একাংশ (AJLabs Infographics)
ক্যাটারপিলার, হুন্দাই ও ভলভো মূলত ফিলিস্তিনি ঘরবাড়ি, স্কুল ও মসজিদ ধ্বংস করতে ব্যবহৃত বুলডোজার ও খনন যন্ত্রাদি সরবরাহ করছে। এই যন্ত্রপাতি দিয়ে দখলদার ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে নতুন বসতি গড়ে তুলছে। যখন মানুষের ঘুম, মায়া, হাসিমুখ সব ধ্বংস হয়ে যায়, তখন এসব কোম্পানি নির্বিঘ্নে বসতি ধ্বংসের কাজে মুনাফা তুলছে। কীভাবে তারা এত শান্ত চোখে দেখছে এই নির্মমতা?
বুকিং.কম ও এয়ারবিএনবি ইসরায়েলি অধিকৃত পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতিতে বাড়ি ও হোটেল ভাড়া দিয়ে মুনাফা করছে। এয়ারবিএনবি ২০১৮ সালে সাময়িকভাবে এসব তালিকা সরিয়ে নিলেও পরবর্তীতে আবার যুক্ত করেছে, এবং যে আয় হয় তার কিছু অংশ মানবিক কাজে দান করার অভিনব নাম দিয়েছে — জাতিসংঘ রিপোর্ট এটিকে “হিউম্যানিটারিয়ান‑ওয়াশিং” বলে অভিহিত করেছে। বসতি গঠন ও লুটপাটকে তারা সরাসরি সাহায্য করছে, অথচ মুখে দেখাচ্ছে ‘দয়াশীলতা’!
চীনের ব্রাইট ডেইরি এখন ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় খাদ্য কোম্পানি টেনুভার মালিক। টেনুভা ফিলিস্তিনিদের দখলকৃত জমি থেকে উৎপাদিত পশুপালন ও খাদ্য বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে আর দখলদারিত্বকে শক্তিশালী করছে। নেটাফিম নামে একটি কোম্পানি পশ্চিম তীরের পানি দখলে অবকাঠামো সরবরাহ করছে—এই প্রযুক্তি দখলদারিত্বকে আরও গভীর করছে। আর গ্লেনকোর ও ড্রামন্ড কোম্পানি কয়লা রপ্তানি করছে, যা ইসরায়েলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার হচ্ছে। যত বেশি বিদ্যুৎ, তত বেশি যুদ্ধ চালানো সহজ—এভাবেই দখলের সিস্টেমকে চালু রাখা হচ্ছে।
ব্ল্যাকরক ও ভ্যানগার্ডের মতো বিশাল বিনিয়োগসংস্থা এসব যুদ্ধ-সম্পৃক্ত কোম্পানিতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। ব্ল্যাকরক প্যালানটিয়ার ৮.৬%, মাইক্রোসফট ৭.৮%, লকহিড মার্টিন ৭.২% মালিক। ভ্যানগার্ড ক্যাটারপিলারে ৯.৮%, লকহিড মার্টিনে ৯.২% অংশীদার। তারা বুঝে ফেলে যে যুদ্ধই হলো লাভজনক প্রকল্প, আর মানবিক মূল্যবোধকে পদদলিত করে তারা সরাসরি এই হত্যাযজ্ঞে অর্থে অংশ নিচ্ছে। বিপিএন পারিবা, বার্কলেস, আলিয়ানজ, এক্সা এরাও ইসরায়েলের বন্ড ও শেয়ারে টাকা ঢেলেছে। এরা এই যুদ্ধকে দেখছে “বিনিয়োগের সুযোগ” হিসেবে।
জাতিসংঘ বলছে, এমন কোনো কোম্পানি বা রাষ্ট্র, যারা ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ও গণহত্যাকে সাহায্য করছে, তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ করছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত বলেছে: ইসরায়েলের দখল অবৈধ, এবং তা “যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে”। এই ৪৮টি কোম্পানি তাই শুধু সহায়তাই দিচ্ছে না, তারা সরাসরি এক হত্যা‑ব্যবসার অংশ।
এই রিপোর্ট এক কঠিন আয়না তুলে ধরেছে—আমাদের প্রতিদিনের ফোন ব্যবহার, অনলাইন কেনাকাটা, এমনকি ব্যাংকে রাখা টাকাও হয়তো এই হত্যাযজ্ঞের পেছনে যাচ্ছে।
এখনও কি সময় আসেনি বলার যে — “আমরা এর অংশ নই। আমাদের টাকা দিয়ে হত্যা চলবে না”? নীরবতা এখন কোনো নিরপেক্ষতা নয়— আজকের নীরবতা মানেই যেন অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো।
তথ্যসূত্র: মূল রিপোর্ট From Economy of Occupation to Economy of Genocide (ফ্রান্সেসকা আলবানিজ)