রাজধানীর মগবাজারের একটি আবাসিক হোটেল – সুইট স্লিপ । স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে উঠেছিলেন সৌদি ফেরত প্রবাসী মনির হোসেন। সন্তান অসুস্থ। চিকিৎসকের দেখা মেলেনি। রাতে হোটেল কক্ষেই ঘটে গেল ভয়াল ঘটনা। স্ত্রী নাসরিন আক্তার স্বপ্না, সন্তান নাঈম হোসেন এবং অবশেষে প্রবাসী মনির— সবাই শেষ। বিষক্রিয়ায়, নাকি পরিকল্পিত খুন—এ নিয়ে তৈরি হয়েছে রহস্য। এখন একে একে বেরিয়ে আসছে সেই রাতের ভয়ঙ্কর তথ্য।
জানা যায়, হোটেল ওঠার পর রাত ৮টা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে ছিলেন মনিরের ঘনিষ্ঠ এবং তার বাড়ি দেখভালের দায়িত্বে থাকা চাচাতো ভাই রফিকুল ইসলাম। খাবার এনে দিয়ে চলে যান তিনি। রাত ১০টায় ফোন আসে মনিরের। ফোন পেয়ে তিনি হোটেল কক্ষ ত্যাগ করেন। এক ঘণ্টা পর ফেরেন পাঁচ লিটারের পানির বোতল এবং খাবার নিয়ে। প্রশ্ন হলো—এই এক ঘণ্টা তিনি কোথায় ছিলেন? কার সঙ্গে সময় কাটালেন? যে খাবার নিয়ে এলেন, সেটি কি তার কেনা নাকি কেউ হাতে ধরিয়ে দিল? হোটেলে ফেরার পরও একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন মনির। সবকিছুই তদন্ত করছে পুলিশ।
এরপরই শুরু হয় বিষক্রিয়ার উপসর্গ। রাতেই সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েন, বমি শুরু হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—কেউ হোটেল কর্তৃপক্ষকে কিছু জানায়নি। সকালে ৬টা ৩৬ মিনিটে মনির ফোন করেন রফিকুলকে। জানিয়ে দেন তাদের মারাত্মক অসুস্থতার কথা। তৎক্ষণাৎ রফিকুল আসেন এবং কাছের একটি ফার্মেসি থেকে ওষুধ আনান। এরপর রফিকুলের মেয়ে হোটেলে এসে দেখেন ভয়াবহ অবস্থা। অথচ এতোক্ষণ হোটেল কর্মীদের অজানাই ছিল। বেলা ১১টার দিকে অবস্থা যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তখন রফিকুল ও তার মেয়ে স্বপ্নাকে আদ্-দ্বীন হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে মনির ও তার ছেলেকে নেয়া হয়।
কিন্তু এর আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন স্বপ্না ও ছেলে নাঈম। আর আইসিইউতে নেয়া মাত্রই মৃত্যু হয় মনির হোসেনের। খবর পেয়ে পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। সোমবার ময়নাতদন্ত করা হয়।
এ ঘটনায় রমনা থানার পুলিশ মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের ধারণা, বিষক্রিয়ায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। তবে সেটা সাধারণ ‘ফুড পয়জনিং’ নয়। কারণ, একই সময়ে তিনজনের মৃত্যু হলে হোটেল বা রেস্তোরাঁর অন্য কারও অসুস্থ হওয়ার কথা। ফলে, খাবারের সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে বিষ মেশানোর আশঙ্কা। রেস্তোরাঁ ও হোটেলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা চলছে। পাশাপাশি মনিরের সঙ্গে শনিবার রাত ১২টা পর্যন্ত কারা ফোনে কথা বলেছিল, সেই তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।
পুলিশ বলছে, মনিরের প্রবাস জীবনের আড়ালে তার রয়েছে বিশাল সম্পদের পাহাড়। নব্বইয়ের দশকে সৌদি আরবে গিয়ে শ্রমিক ভিসায় যাওয়া মনির পরে ঠিকাদারি ব্যবসায় নামেন। বিপুল অর্থ উপার্জন করে দেশে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ ও ঢাকার কেরানীগঞ্জে গড়ে তোলেন একাধিক বাড়ি ও বাস ব্যবসা। কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদে কিনেছিলেন তিনতলা ও পাঁচতলা দুটি বাড়ি, যা থেকে মাসে দেড় লাখ টাকা ভাড়া ওঠে। এই বাড়ি এবং সম্পদের দেখভাল করতেন দূর সম্পর্কের চাচা রফিকুল ইসলাম। এমনকি বিদেশ থেকে এক কোটি টাকা ব্যাংক ট্রান্সফারে রফিকুলের একাউন্টে পাঠানো হয়েছিল ওই বাড়ি কেনার জন্য।
পুলিশ জানায়, সম্পদ সংক্রান্ত কোনো বিরোধ বা শত্রুতা ছিল কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারণ প্রবাসী মনিরের তিন ভাইও প্রবাসে। বড় ভাই ইতালি থেকে ইতিমধ্যেই দেশে ফিরেছেন। রোববার রাতেই রফিকুল, তার মেয়ে এবং মেয়ের স্বামীকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে দু’জনকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলেও রফিকুলকে থানায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
মনিরের চাচাতো ভাই জাকির হোসেন জানালেন, প্রায় ৩০ বছর প্রবাস জীবন পার করা মনির বড় ভাইয়ের অপেক্ষায় ছিলেন। অথচ সেই ফিরে এল লাশ হয়ে।
একটি হোটেল কক্ষে এক পরিবারের তিন প্রাণ ঝরে যাওয়া এই ঘটনা নিয়ে এখন ঢাকার মানুষ আতঙ্কিত। এ ঘটনা কি শুধুই বিষক্রিয়া, নাকি পারিবারিক সম্পদ নিয়ে নির্মম ষড়যন্ত্র? কে দিল সেই খাবার? আর কারা ছিল ফোনের ওপারে? হোটেলের এক ঘণ্টার বাইরে থাকার সময়ে কী ঘটেছিল? সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে পুলিশ।
আর দেশজুড়ে বাড়ছে সংশয় ও ক্ষোভ—এত সম্পদের মালিক এক প্রবাসীর পরিবার কীভাবে এমন নৃশংস পরিণতির শিকার হলো? তাতে কি সম্পদের লোভ, না ব্যক্তিগত প্রতিশোধ? সময়ই দেবে উত্তর।