গত শুক্রবার থেকে সোমবার পর্যন্ত ইসরায়েলি বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের বিভিন্ন শহরে মোট ২২৪ জন মানুষ নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন প্রায় ৯০০ জনের মতো। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ও স্থানীয় পত্রিকাগুলো এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। রবিবারের নিহতদের মধ্যে আছেন ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)-এর গোয়েন্দা শাখার প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং আরও দুই জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা।
হামলায় যারা নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন সাধারণ বেসামরিক মানুষ। শিশু, নারী ও বয়স্কদের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণ ইরানের একটি শিশু হাসপাতাল এবং বেশ কিছু স্কুল ও আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টেহরান, ইসফাহান, কেরমানশাহ ও শিরাজে একযোগে হামলা চালানো হয়। শনিবার সন্ধ্যায় টেহরানে পরপর তিনটি বড় বিস্ফোরণে শহরের বিভিন্ন অংশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেক বাসিন্দা রাতে নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে পারেননি। কেউ কেউ মেট্রো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে রাত কাটান, কারণ সেখানে আশ্রয়ের জন্য আলো, পানি ও কিছু খাবার ছিল। রাজধানীতে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল, ফলে বহু মানুষ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।
ইসফাহান ও শিরাজের সামরিক ঘাঁটিগুলোর আশপাশেও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটেছে। সরকারি সূত্র জানিয়েছে, ফরডৌ অঞ্চলের গোপন পারমাণবিক গবেষণা স্থাপনাকে লক্ষ্য করেও হামলা চালানো হয়, যদিও সেখানকার ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি। নিহত আইআরজিসি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং বিদেশি গোয়েন্দা তৎপরতা মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন বলে জানা গেছে।
ইসরায়েল এই অভিযানের নাম দিয়েছে “Rising Lion”। তাদের দাবি, হামলার লক্ষ্য ছিল সামরিক স্থাপনা ও সন্ত্রাসবাদে জড়িত বাহিনীর ঘাঁটি। কিন্তু ইরানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটি ছিল একটি পরিকল্পিত ও অমানবিক যুদ্ধাপরাধ, যার উদ্দেশ্য ছিল বেসামরিক মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো এবং দেশকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও জানায়, হামলার প্রকৃতি ও স্থান বিবেচনায় এটি সাধারণ নাগরিকদের ওপর সরাসরি হামলা হিসেবে দেখা যায়।
এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেই এক ভাষণে বলেন, “আমাদের জনগণের রক্ত বৃথা যাবে না। প্রতিশোধ হবে সময়মতো এবং নির্মম।” ইরানের অভ্যন্তরে ও বাইরে থাকা কয়েকটি প্রবাসী গোষ্ঠী এবং বিশ্লেষকরাও আশঙ্কা করছেন, এই ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে পরিস্থিতি শান্ত রাখতে উভয় পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এদিকে, উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের নিচে জীবিত ও মৃতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। টেহরান বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসফাহানের কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে হাসপাতালগুলোতে কাজ করছেন। সরকার তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে এবং দেশব্যাপী স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় জেনারেল কাসেম সোলাইমানির মৃত্যুর পর এই হামলাকে ইরানের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ সামরিক আঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এটিকে মধ্যপ্রাচ্যে আরও বড় সংঘাতের পূর্বাভাস হিসেবেও দেখছে।