রহম আলী – পাটগ্রাম রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের এক কোণে নির্বাক হয়ে বসে আছেন এক যুবক। রহম আলীর চোখেমুখে গভীর শোক, ক্লান্তি আর অসহায়ত্বের ছাপ। ভারতের আসাম রাজ্যের নাগাঁও জেলার বাসিন্দা বলে নিজেকে পরিচয় দিলেও আজ তিনি বাংলাদেশে একেবারে ঠিকানাহীন। জানালেন, ঈদের ঠিক ক’দিন আগে রাতের অন্ধকারে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ তাকে জোর করে ঠেলে দিয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে। সেই থেকে এ স্টেশন থেকে ও স্টেশন, কোথাও তার ঠাঁই নেই, মাথা গোঁজার ঠিকানা নেই।
কান্নাজড়িত গলায় রহম আলী বললেন, “আমার জন্মভিটা আসাম রাজ্যের জুড়িয়া গ্রামে। আমার বাবা আব্দুল মাসুদ, ভাই-বেরাদর সবাই ভারতীয় নাগরিক। ঘরে ঘরে ভোটার আইডি কার্ড, ভূমির কাগজ, পুরনো সব নথি আছে। তবুও বিএসএফ কোনো কথা শুনলো না। পরিচয়পত্র দেখানোর সুযোগটুকু পর্যন্ত দিল না। ঈদের আগে রাতে ঘর থেকে তুলে এনে খালি গায়ে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দিল। তখন থেকে আমি রাষ্ট্রহীন। আমার স্ত্রী-সন্তানরা ভারতে। আর আমি এখানে অজানা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে আছি। কী করবো, কোথায় যাবো—কিছুই জানি না।”
পাটগ্রাম স্টেশনের চায়ের দোকানি রমজান আলী কষ্টভরা সুরে বললেন, “কয়েকদিন ধরে মানুষটারে স্টেশনে ঘুরতে দেখছি। খুব অসহায় অবস্থা। কেউ দেখে না, খোঁজও নেয় না। শুনলাম ইন্ডিয়া থেকে বিএসএফ পাঠাই দিছে। আহারে, বউ-বাচ্চার কথা মনে করে কত কান্নাকাটি করে। এই লোকগুলো কোথায় যাবে, কী খাবে? সরকার কি দেখবে না এসব?”
সমাজকর্মী আজমল হোসেন জানালেন, এই ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। প্রায়ই দেখা যায় বিএসএফের তাড়া খেয়ে বা জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো মানুষেরা কোনো স্টেশন, বাজার বা গাছতলায় আশ্রয় নেয়। রহম আলীর ঘটনা তারই এক নির্মম উদাহরণ। একজন মানুষকে তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে, নিজের দেশ-পরিচয় কেড়ে নিয়ে এভাবে সীমান্তের ওপারে ফেলে দেওয়া এক ভয়াবহ অমানবিক কাজ। এটা সরাসরি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। তিনি বলেন, “মানবিকতার জায়গা থেকে আমাদের প্রশাসন, বিজিবি ও দুই দেশের সরকারকে এ বিষয়ে জরুরি আলোচনায় বসতে হবে। নয়তো এসব নিরীহ মানুষ এভাবেই অবহেলায় পড়ে থাকবে, যারা কারও নয়।”
বাংলাদেশের মাটিতে ঠিকানাহীন রহম আলীদের গল্প বারবারই শোনাচ্ছে সীমান্তের মানবিক বিপর্যয়ের করুণ সুর।